0

ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in



ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা - ১৬
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়




Diary Entry - 14
21 August 1942, Friday


প্রিয় কিটি, 

তোমায় বলা হয়নি, ইতিমধ্যে, আমরা আমাদের গোপন অ্যানেক্সের প্রবেশ পথটাকে ভাল মতো গোপন ও সাধারণের চোখে আড়াল করতে পেরেছি। এর ফলে আমাদের গোপন আস্তানাটা পুরোপুরি একটা গোপন বা গুপ্তকক্ষে পরিণত হয়ে গেছে। বাইরে থেকে এসে তুমি আর সহজে এর ভিতরের অস্তিত্বটা বুঝতে পারবে না। আসল বুদ্ধিটা হলো মিঃ ক্রেলারের (Mr. Kraler)। এতদিন স্বাভাবিক কারণেই মূল অফিস বিল্ডিং-এর সাথে আমাদের উপগৃহ বা অ্যানেক্সের মধ্যে সংযোগ হিসাবে একটা দরজা ছিল। মাঝখানের ঐ দরজাটা দেখে যে কারুর সন্দেহ বা আগ্রহ জন্মাতে পারত ভিতরে কি আছে, তা’ দেখার বা জানার । মিঃ ক্রেলার এটা উপলব্ধি করে, যেটা করলেন তা’ হলো, ঔ সংযোগকারী দরজার সামনে অফিসের খাবার-দাবার রাখার আলমারিটাকে এমনভাবে ‘সেট’ করে দিলেন, যাতে বাইরে থেকে কেউ বুঝতে না পারে যে ওখানে একটা দরজা আছে, বা ঐ দরজা দিয়ে অন্যত্র যাওয়া যায় (এর অবশ্য অন্য একটা কারণও আছে, সেটা তোমায় না বললে, তুমি ঠিক বুঝতে পারবে না, কেন এ’রকম করা হলো!!)। ইদানীং গেষ্টাপো বাহিনীর সদস্যরা এলাকার কোথাও কোনও বাড়িতে সাইকেল লুকানো আছে কি’না তা’ দেখার ছল করে, বাড়ির মধ্যে প্রায় বিনা অনুমতিতে ঢুকছে, আর দেখার নামে খানাতল্লাশী চালাচ্ছে। আর তাই মিঃ ক্রেলার বুদ্ধি করে আমাদের মাঝখানের দরজাটা আড়াল করে দিনেল, যাতে কারুর প্রথমেই সন্দেহ না’ হয় যে ভিতরে আরও একটা জায়গা বা থাকার মতো অংশ আছে। তবে মিঃ ক্রেলার খাবার আলমারিটাকে বই ও ফাইল রাখার আলমারি করে এমনভাবে রেখেছেন, যাতে, প্রয়োজনে, অল্প আয়াসেই সেটা সরানো বা নড়ানো যায়, এবং উপগৃহে বা অ্যানেক্সে প্রবেশ করা যায়। ঔই দরজাটাকে মিঃ ক্রেলার মিঃ ভোসেনের সহায়তায় স্যুইং দরজা হিসাবে তৈরী করেন। এইজন্যেই অল্প আয়াসেই এটা খোলা বন্ধ করা যেত। 

আসলে কাজটা মিঃ ক্রেলার করেছিলেন মিঃ ভোসেনের (Mr. Vossen) সক্রিয় সহযোগিতায়। বুদ্ধিটা ছিল মিঃ ক্রেলারের আর কাজটা করেছিলেন মিঃ ভোসেন, (মিঃ ভোসেন হলেন বেপ ভোস্কুজী বা ইলি ভোসেনের বাবা। ইলি ভোসেনকে অ্যানি তার ডাইরিতে বেপ ভোস্কুজী নামে উল্লেখ করেছে)। 

মিঃ ভোসেন, বেপ ভোস্কুজী তথা, ইলি ভোসেনের বাবা। ইনিও ওপেক্টো হাউসে ট্রাভিস কম্পানীতে কাজ করতেন। মিঃ ভোসেনের আসল নাম ছিল মিঃ জোহানেস ভস্কুজী। ওপেক্টো হাউসের ট্র্যাভিস কম্পানীতে তিনি সেক্রেটারীর সাহায্যকারী হিসাবে কাজ করতেন। তিনি খুব দক্ষ কাঠের কাজের কাজের মিস্ত্রী ছিলেন। পরিভাষায় তাঁকে “ছুতোর বা কাঠের মিস্ত্রী বলা যায়। তিনিই অ্যানিদের উপগৃহের বা অ্যানেক্সের বইয়ের ও ফাইল র‍্যাকের স্যুইং দরজা তৈরী করেছিলেন। ১৯৪৫ সালে তিনি অ্যাবডোমিনাল ক্যান্সারে মারা যান। 

মিঃ ভোসেন খুব ভাল কাঠের কাজের কারিগরি বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। আমরা আসার আগেই, মিঃ ভোসেনকে আমাদের এই উপগৃহটিকে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু তখন কার্যতঃ সময়ের অভাবে বা অন্য কোনও কারণে এর নিরাপত্তার বিষয়ে ভাল করে কিছু করতে পারেননি। এমন কি আমাদের ন্যুনতম স্বাচ্ছন্দের বিষয়েও খুব একটা কিছু করে উঠতে পারেননি। যেমন নীচের তলায় যাওয়ার জন্য এখন আমাদের প্রথমে সিঁড়ির শেষ প্রান্তে নেমে গিয়ে, ঘাড় নিচু করে, কিছুটা লাফ দিয়ে নীচে নামতে হয়। লাফ দিতে হয়, কারণ সিঁড়ির শেষের দিকের ধাপগুলো নেই। আর মাথা নিচু করতে হয়, কারণ ওপর থেকে নীচে নামার শেষ দরজাটা বেশ নীচু। তাই কেউ যদি মাথা নীচু করে ঠিক সময়ে লাফ না দেয়, তা’হলে অতি অবশ্যই সে তার মাথায় বেশ জোরে একটা ঠোকা খাবে। প্রথম প্রথম আমরা প্রায় সবাই, অনভ্যাসের কারণে, বার বার মাথায় ঠোকা খেয়েছি। প্রত্যেকের কপালের দিকে তাকালে তুমি দেখবে, সাবার কপাল কম বেশী ফোলা বা একটা আঘাত খাওয়ার জায়গা দেখতে পাওয়া যাবে। কারণ আর কিছুই নয়, আমরা প্রত্যেকে এই দরজাটায় একবার না একবার ঠোকা খেয়েছি। মিঃ ভোসেনের কারিগরীতে এখন আর আমরা এই প্রবল ধাক্কাটা খাচ্ছি না, বা ধাক্কা খাওয়ার ভয়টা আর নেই। মিঃ ভোসেনের পরামর্শে এবং সাহায্যে আমরা একটা বড় উলের খণ্ডকে সাধারণ কাপড়ের সঙ্গে জড়িয়ে দরজার ওপরে, যেখানে আমাদের মাথা বারবার ঠুকে যাচ্ছিল, সেখানে পেরেক দিয়ে আটকে দিয়েছি। এখন ঠোকা লাগলে, ঔই উলের বালিশটা আমাদের মাথাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে। ঠোকা খেয়েও কপাল আর ফুলে যাচ্ছে না। সুতরাং আশা করতেই পারি, ভবিষ্যতে এ’রকম সহায়তা পেলে, আমাদের আর কোন অসুবিধাই হবে না। আশা করি, এটার মতোই আমাদের অন্য সমস্যাগুলোরও যথাযথ সমাধান হয়ে যাবে। 

জান, কিটী এখানে আসার পর থেকেই আমি মোটামুটি আমার পড়াশুনাটাই বন্ধ করে দিয়েছি। সত্যি বলতে কি, শুধু পড়াশুনাই নয়, বিশেষ কোন কাজও করছি না। অবস্থা বিবেচনা করে, আমি নিজেই আমাকে আগামী সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ছুটি দিয়ে দিয়েছিলাম। আর এরপর বেশ নিশ্চিন্তই ছিলাম। কিন্তু বাবা বোধহয় ছিলেন না। পড়াশুনার ব্যাপারে আমার এই ছন্নছাড়া অবস্থা দেখে, বিশেষ করে, নিজেকে নিজেই ছুটি দেওয়ার সাহস দেখে, শেষ পর্যন্ত বাবা ঠিক করেছেন, এবার থেকে তিনি নিজে আমাকে নিয়ে পড়াতে বসাবেন, এবং পড়াবেন। বিষয়টা, বিশ্বাস কর, আমার কাছে বেশ অস্বস্তি ও লজ্জার বিষয়। কারণ আমি জানি বাবা আমায় পড়াতে বসিয়েই দেখবেন, ইতিমধ্যে আমি অনেক কিছুই ভুলে গেছি। ব্যাপারটাও বাস্তবেও ঠিক তাই-ই ঘটল। বাবার কাছে পড়তে গিয়ে দেখি, আমি সত্যিই অনেক কিছু ভুলে গেছি। আমারই লজ্জা লাগছিল। বাবা অবশ্য এর জন্য আমায় দোষারোপ করেননি। শুধু আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ছিলেন। কিন্তু আমি ত’ বুঝতে পারছিলাম, আমার কি অবস্থা!! তবে এর একটা গ্রহণযোগ্য কারণও আছে। সেটাকেও তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। গত দুতিন মাস আমার চারদিকে, আমাদের বেঁচে থাকার প্রাণান্তকর চেষ্টা নিয়ে যা’ ঘটে চলেছে, তাতে আর যাই হোক পড়াশুনার বিষয়বস্তু মাথার মধ্যে থাকা সম্ভব নয়। হঠাৎ করে আমাদের জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আমরা এখন ইহুদি হয়ে অন্তরালে লুকিয়ে আছি। এই পরিবর্তনকে নিশ্চয়ই হাল্কাভাবে নেওয়া যায় না। 

আর একটা কথা। শুনে আবার আশ্চর্য হয়ে যেও না। আমি আর মিঃ ভ্যান ড্যান এখানের যতকিছু বেসামাল ঘটনা সামলানোর চেষ্টা করি। বেসামাল, মানে কেউ যখন মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন আমাদের কাজ হলো তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে মানসিকভাবে শক্ত করে তোলা। এ’ছাড়াও নরম মনের মারগটকে মিঃ ভ্যান ড্যান আমার থেকে বেশী ভালবাসেন। কারণ সে কিছুরই প্রতিবাদ করে না চুপচাপ থাকে। আমার মতো সব ব্যাপারে মাথা (নাক) গলায় না। এ’ছাড়াও জান, মা সবসময় আমার সাথে এমন ব্যবহার করেন, যেন মনে হয় আমি একটা বাচ্চা মেয়ে, যে এখনও নিজের ভালমন্দ ভাল করে বোঝে না। যাই হোক না কেন, সব কিছু সহ্য করতে রাজি কিন্তু মায়ের এই মনোভাব আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারি না। 

এইসব টুকরোটাকরা ঘটনা ছাড়া, আমাদের এখানে বেশ ভালই চলছে, সব কিছু। জান, এতদিন হয়ে গেল, আমি এখনও পর্যন্ত কোনভাবেই পিটারকে সহ্য করতে পারলাম না। ছেলেটার আচার- আচরণ অত্যন্ত বিরক্তিকর, ক্লান্তিকর। যখন তখন বিছানার ওপর ধপ ধপ করে ওঠানামা করবে, বারণ করলে, বোকার মতো হাসবে। আদ্যন্ত একটা কুঁড়ে টাইপের ছেলে। দিনের অর্ধেক সময় বিছানার ওপর কাটাতে পারলে, সে পৃথিবীতে আর কিছু চায় না। দিনের মধ্যে যেটুকু সময় বিছানার বাইরে থাকে, সেইটুকু সময় কাঠ বা কাঠের টুকরো নিয়ে, একটু আধটু আগে শেখা কাঠের কাজ ঝালিয়ে নেয়। আমি বলি ছুতোর গিরি করে। তারপর আবার বিছানায় বসে বয়স্কদের মতো ঝিমোয় বা তন্দ্রাচ্ছন্ন ভঙ্গীতে সময়টা কাটিয়ে দেয়। যেন কতই না পরিশ্রম করেছে!! সত্যি, এরকম একটা ছেলেকে আস্ত কুঁড়ে আর বোকা ছাড়া কিছু বলা যায় ? 

যাই হোক আপাততঃ চারদিকের আবহাওয়াটা বেশ মনোরম ও সুন্দর। যখন কোন কিছুই ভাল লাগে না, পিছনের দিনগুলো তখন স্মৃতিতে ঝাঁপ দিয়ে এসে, সবকিছুকে বিবর্ণ করে দেয়, তখন অন্ততঃ চারদিকের প্রাকৃতিক শোভা কিছুটা হলেও মনটাকে হাল্কা হতে সাহায্য করে। ওপরের চিলেকোঠার ছাদে, ক্যাম্প খাটটার ওপর শুয়ে, যখন ওপরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি, কিংবা জানলার সরু ফাঁক দিয়ে, দূরের আকাশে লাল সূর্যকে ভেসে ভেসে আকাশের ওপর থেকে আরও ওপরে উঠতে দেখি, তখন মনে হয় আর কিছু না হোক, এখনও পর্যন্ত ত’ আকাশে সূর্যের উদয় দেখতে পারছি। না’হয় আকাশটাই আমাদের থেকে আনেক দূরে সরে গেছে। আমাদের কাছে সেটা জানলার সরু ফাঁকে বন্দী হয়ে গেছে। তবুও এখনোও ত’ কেউ সেটুকু কেড়ে নিতে পারেনি। ওই আকাশটুকুতে ত’ আমরা এখনোও স্বাধীন। ওটা ত’ এখনও ইহুদিয়ের জন্যে আলাদা হয়ে যায়নি। ওইটুকু আকাশ দেখা থেকে আমাদের কেউ বিরত করতে পারবে না। তুমি কি বল ?? 



ইতি,

তোমার অ্যানি। 



অনুবাদকের সংযোজন -

অ্যানি তার ডাইরিতে বিভিন্ন প্রসঙ্গে, তাদের সহবাসী ভ্যান ড্যান পরিবারের মিঃ ভ্যান ড্যান ও শ্রীমতী ভ্যান ড্যান-এর বিষয়ে, নিজস্ব ভাবনা চিন্তা প্রকাশ করেছে। অনেক সময় সেগুলোকে অপরিণতের মন্তব্য বলে মনে হতে পারে। কিন্তু তাই বলে তার পর্যবেক্ষণকে সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করাও যাবে না। কারণ অ্যানি তার ডাইরিতে যা কিছু লিখেছে, তার সবটাই তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ, নিজস্ব উপলব্ধি। এই পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধিকে সবাই মেনে নিয়েছে, এবং তার চোখ দিয়ে, হিটলারের ইহুদি অত্যাচারের ইতিহাসকে আরও স্পষ্ট ভাবে বোঝার চেষ্টা করেছে। 

শ্রীমতী ভ্যান ড্যান - শ্রীমতী ভ্যান ড্যানকে ওপর ওপর দেখলে, প্রাথমিকভাবে একজন সহজ সরল সাদাসিধে মহিলা বলেই মনে হতো। তবে এরই সঙ্গে শ্রীমতী ড্যানের অস্থিরমতি মানসিকতা, অকারণে উদ্বিগ্ন ও চঞ্চল হয়ে ওঠার এক অদ্ভূদ প্রবণতা ছিল। তাঁর এই স্বভাব, মাঝেমাঝেই এই অ্যানেক্সের বাসিন্দা, দুটি পরিবারকে বেশ সমস্যায় ফেলত। বিশেষ করে, নির্দিষ্ট কারণে, যদি অ্যানেক্সের কেউ শ্রীমতী ভ্যান ড্যানের পরিবারের কারুর নামে, তার সামনে, তার অপ্রিয় কিছু বলত বা বলে ফেলত, তা’হলে তাঁর মেজাজ আরও বিগড়ে যেত। অ্যানির আবার স্বভাব ছিল চ্যাটাং চ্যাটাং করে মুখের ওপর কথা বলা, বা যে কোন কথার জবাব দেওয়া। সেটা শ্রীমতী ড্যান কোনভাবেই সমর্থন করতেন না। আর তাই শ্রীমতী ড্যান অ্যানির চেয়ে তার দিদি মারগটকে বেশী ভালবাসতেন। অ্যানির তুলনায়, মারগট ছিল অনেক বেশী শান্ত। সে বেশীরভাগ সময় মায়ের কাছে কাছে ঘুরত। বাড়ির নিত্যকার কাজে মাকে, সময়ে সময়ে শ্রীমতী ড্যানকে সাহায্য করত। তাই শ্রীমতী ড্যানের কাছে, অ্যানির চেয়ে মারগট অনেক ভাল মেয়ে ছিল। অ্যানি যখন তার বাচালতার জন্যে বা অন্য কোন কারণে মায়ের কাছে, বা বাবার কাছে বকুনি খেত, তখন, শ্রীমতী ড্যান হঠাৎ কেমন বেশী উদাসীন হয়ে পড়তেন। অ্যানি তার ডাইরিতে লিখেছে, যে সে, চোখের কোণ দিয়ে দেখেছে, অ্যানির বকুনি খাওয়ার সময়, শ্রী মতি ড্যানের চোখ দুটো কেমন যেন আনন্দে চক চক করত। অ্যানির দুর্দশায় তিনি মনে মনে খুশী বই দুঃখিত হতেন না। এই কারণেই অ্যানি কোনও সময়ই শ্রীমতি ড্যানকে উদাসীন, বা সহজ সরল মনের মহিলা বলে মনে করত না। যদিও অ্যানেক্সের অফিসে যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই শ্রীমতী ড্যানকে সহজ সরল মহিলা বলেই মনে করত। 

শ্রী ভ্যান ড্যান - অন্যদিকে শ্রীমতী ভ্যান ড্যানের স্বামী শ্রীযুক্ত ভ্যান ড্যানের স্বভাব ছিল বাহ্যিক সাজ পোশাকের মাধ্যমে, হাবভাব কথাবার্তার মাধ্যমে নিজেকে অন্যের সামনে চতুর বুদ্ধিমান কৌশলী ইত্যাদি প্রমাণ করা। অ্যানি অবশ্য মনে করত, শ্রী ভ্যান ড্যান আদৌ ওই রকম ছিল না। বরং অল্পেতেই তিনি ভয় পেয়ে যেতেন। আসলে তিনি একজন ভীতু প্রকৃতির লোক ছিলেন, যিনি সর্বদা নিজেকে সাহসী, চতুর ও কৌশলী প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন। অথচ বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, কোন কঠীনতম মুহূর্তে বা পরিস্থিতিতে নিজেকে এবং নিজের বোধ বিবেচনাকে শীতল রেখে, ওটো ফ্রাঙ্কের মতো স্থির সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর একদমই ছিল না। অবশ্য এটাও ঠিক, অ্যানি তার বাবাকে অসম্ভব রকেমের ভাল বাসত। তার কাছে তার বাবাই ছিলেন আদর্শ পুরুষ। অ্যানি তার ডাইরিতে শ্রী ভ্যান ড্যানের চরিত্র যেভাবে চিত্রিত করেছে, তাতে এ’কথা মনে হতেই পারে, যে তিনি ছিলেন চূড়ান্ত স্ত্রৈণ। শ্রীমতী ভ্যান ড্যানের ভুল কথার বা ভুল আচরণের বিরোধীতা করার ন্যুনতম সাহস বা ক্ষমতা তাঁর ছিল না। 

অন্য প্রসঙ্গ -

অ্যানি তার ডাইরিতে বিভিন্ন দিনের তার বিভিন্ন মানসিকতাকে তার কল্পিত বন্ধু কিটীর কাছে বলেছে। তাই ভিন্ন ভিন্ন দিন বিভিন্ন ফরম্যাটে নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা হিসাবে পকাশিত হয়েছে। তাই ডাইরির বিভিন্ন পাতায় অ্যানি একদিকে যেমন তার নিজের পরিবারের সদস্যদের আচার আচরণের বর্ণনা দিয়েছে, তেমনি তার লেখার মধ্যে দিয়ে আমরা জানতে পারি বা অনুমান করতে পারি অ্যানেক্সে অ্যানিদের সঙ্গে থাকা অন্যান্য সহ পরিবারের সদস্যদের আচার আচরণ ব্যবহার ইত্যাদি। প্রসঙ্গতঃ অ্যানির ডাইরি লেখা বা বন্ধু কিটীর সৃষ্টি, এসবই সে করেছিল তার প্রিয় লেখিকা সেটস্কী- ডি- হানের ( Setske de Haan ) সৃষ্ট কল্পিত চরিত্র জোওপ- টার- হিউলকে ( Joop tar Heul ) অনুসরণ করে। জোওপ-ও এভাবেই তার বন্ধুদের চিঠির মাধ্যমে তার জীবন ও দিনযাপনের বিভিন্ন ঘটনা জানাত। 

এই প্রসঙ্গে আমরা পরে বিস্তারিত আলোচনা করব। তার আগে আমরা একঝলকে দেখে নেব, অ্যানেক্স ভবনে, দুটি পরিবারের মোট সাত জন ও অষ্টম ব্যক্তি ফ্রিটজ ফ্রেফার ( Fritz Preffer ), কে কোথায় কিভাবে অবস্থান করত। অ্যানি সপরিবারে তার বাবা মায়ের সঙ্গে, (মারগট অ্যানিরা অ্যানেক্স ভবনে পৌঁছানোর আগেই, মিয়েপের সাথে সাইকেলে পৌঁছে গিয়েছিল।) অ্যানেক্স ভবনে অন্তরালবর্তী হওয়ার কিছুদিন পর সেখানে সপুত্র শ্রী ও শ্রীমতী ভ্যান ড্যান আসেন। তাঁদের আসার দু-এক দিনের মধ্যেই ফ্রেফার এসে পৌঁছান। 

প্রথমে আসার সুবাদে, অ্যানি ও তার পরিবার অ্যানেক্সের দ্বিতীয় তলায় থাকত। দ্বিতীয় তলায় পাশাপাশি দুটি ঘর ছিল। তার একটিতে একটা খাট বিছানা ও অপর দেওয়ালে একটি সোফা ছিল; আর একটা ঘরে দুটি খাট-বিছানা ছিল। এছাড়া প্রথম ঘরটির বাইরে একটি ওয়াশ-বেসিন ছিল। একতলা ও দ্বিতীয় তলার মধ্যে, বইয়ের র‍্যাক তথা ফাইল র‍্যাক রাখা ছিল, যাতে সহজে কেউ বুঝতে না পারে যে ও প্রান্তে থাকার মতো ব্যবস্থা করা আছে। প্রথমে দুটি খাটওয়ালা ঘরটিতে, অ্যানি আর মারগট শুতো। আর তাদের বাবা মা পাশের ঘরের খাটটিতে শুতেন। তৃতীয় তলার বড় ঘরটাতে, অ্যানি ও তার পরিবার খাওয়ার জায়গা হিসাবে, এবং বসার জায়গা হিসাবে ব্যবহার করতেন। এরপর ফ্রিফার যখন অ্যানেক্সে থাকার জন্যে এলেন, তখন ফ্রিফার অ্যানির সাথে দ্বিতীয় ঘরটাতে, যেখানে দুটি খাট ছিল, সেখানে থাকতে লাগলেন। এবং মারগট তখন, পাশের ঘরে বাব মায়ের সঙ্গে শুত। ঐ ঘরের মধ্যেকার সোফাতে মারগট শুতো। 
এই ছকটির দিকে মাননীয় পাঠককুলকে পুনরায় একবার মনোনিবেশ করার অনুরোধ করা হচ্ছে। 

অ্যানেক্সের তৃতীয় তলায় সপরিবারে মিঃ ও মিসেস ড্যান তাঁদের পুত্র পিটারকে নিয়ে থাকতেন। তৃতীয় তলায়, একটি বড় শোওয়ার ঘর ছিল। দ্বিতীয় তলার দুটি শোওয়ার ঘরের প্রায় সমআয়তন বিশিষ্ট শোওয়ার ঘর তৃতীয় তলায় ছিল। তৃতীয় তলার শোওয়ার ঘরের বর্ধিত অংশটিতে, একটি বড় টেবিল ছিল। দিনের বেলায় দুটি পরিবার ঐ টেবিলটিকে খাওয়ার টেবিল হিসাবে ব্যবহার করতেন। এ’ছাড়াও, জায়গাটি দিনের বেলায় বসবার জায়গা হিসাবেও ব্যবহৃত হতো। বড় ঘরটির পাশে আর একটি ছোট ঘর ছিল। যেখানে একটি খাট ভাল ভাবে রাখার মতো জায়গা ছিল। ঐ ঘরে শ্রী ও শ্রীমতী ভ্যান ড্যানের পুত্র পিটার থাকত। ঐ ঘরের ঠিক পাশ দিয়ে, চিলেকোঠায় ওঠার সিঁড়ি ছিল। চিলেকোঠায়, অন্তরীণে থাকা আট জন ব্যক্তির সাপ্তাহিক খাবার মজুত করা থাকত। অ্যানি আর পিটার মাঝে মাঝেই চিলেকোঠায় উঠে যেত। এবং সেখানে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প করত। 

অ্যানেক্সের বাসিন্দারা সারাদিন, অ্যানেক্সের চারদিকের জানালা মোটা পর্দা দিয়ে ঢাকা রাখত, যাতে বাইরে থেকে কেউ অ্যানেক্সের ভিতরের কাউকে না দেখতে পায়। এবং অনুমান করতে না পারে, যে, ভিতরে কেউ আছে। চিলেকোঠার ছোট জানালাতেও একটা পর্দা টাঙ্গানো ছিল। তবে সেই পর্দাটাই একমাত্র মাঝে মাঝে দিনের বেলায় সরিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যেত, বা, দেখার অনুমতি ছিল। 

নীচে একটি ছবি দেওয়া হলো। চিলেকোঠার ঐ জানালা দিয়ে অ্যানি দূরের বড় বাদাম গাছটাকে দেখত। অ্যানি ঐ বাদাম গাছটার দিকে তাকিয়ে বাইরের পৃথিবীতে প্রাণের সন্ধান করত। ঐ টুকু আলো ছাড়া অ্যানিদের কাছে বাইরের পৃথিবী দেখার আর কোনও উপায় ছিল না। এইখানেই পিটার আর অ্যানি উঠে মাঝে মাঝে গল্প করত। কিছুটা দূরের আলোর সাথে জীবনের স্বাদ পেত।
চিলেকোঠার ঘর। সামনের জানালা দিয়ে অ্যানি দূরের বাদাম গাছের দিকে তাকিয়ে জীবনের স্বাদ পাওয়ার চেষ্টা করত। 


চিলেকোঠায় ওঠার সিঁড়ি ছিল পিটারের ঘরের মধ্যে দিয়ে। পিটারের ঘরটা তুলনামূলকভাবে একটু ছোট থাকলেও, পিটারের ঘরটা ছিল বেশ নিরিবিলি। 
পিটারের ঘর। ঘরের পাশ দিয়ে একটা সিঁড়ি দেখা যাচ্ছে। ঐ সিঁড়িটা দিয়েই অ্যানেক্সের চিলেকোঠা।য় ওঠা যেত। 


অ্যানেক্সের বাসিন্দারা চিলেকোঠার ঘরটাকে মূলতঃ তাদের সাপ্তাহিক খাবারের রেশন রাখার কাজে ব্যবহার করত। তাই আকৃতিতে ছোট চিলেকোঠার ঘরটি বিভিন্ন প্যাকিং বাক্স, খাবার ভর্তি কার্টুনে প্রায় ঠাসা ছিল। নীচের ছবিতে চিলেকোঠার ঘরটিকে কিভাবে খাবার রাখার জায়গা হিসাবে ব্যবহার করা হতো, তার একটি চিত্র দেওয়া হলো, যাতে পাঠকরা ঘরটির একটি সম্ভাব্য ধারণা পেতে পারেন।
এই ঘরে সাপ্তাহিক খাবার বা রেশন রাখা হতো। কোণের দিকের প্যাকিং বাক্সগুলোতে সাপ্তাহিক খাবার রাখা আছে।

0 comments: