0

ধারাবাহিক - সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক


এক কিশোরীর রোজনামচা - ২০
সুজিত নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়



Diary Entry -18
27 September, 1942, Sunday



প্রিয় কিটী, 

তুমি বিশ্বাস করবে, মাকে আমার দেখে মাঝে মাঝে, ওই অতীতকালের বড় বড় ধাতব মূর্তিগুলো আছে না, তাদের মতো মনে হয়। মনে হয় এ’রকম একটা ধাতব মূর্তির সাথে আদৌ থাকা সম্ভব নয়। এদের না আছে প্রাণ, না আছে কোন রকম বাঁচার ইচ্ছা। এরা কেবল ধাতব মূর্তির মতো আবহমানকাল ধরে সকলের সামনে দাঁড়িয়ে দিন কাটিয়ে যেতে পারে, কিন্তু জীবন্ত মানুষের মতো কিছু বলতে, বা কিছু কিছু ব্যাপারে প্রতিবাদ করতে পারে না। তাই এরা মানুষের মতো বাঁচতে পারে না। শুধু মাকেই বা কেন “ধাতব মূর্তির” মতো বলব! মারগটও ত’ প্রায় একইরকম। মারগটের সাথেও একমত হয়ে পায়ে পা মিলিয়ে চলা সম্ভব নয়। তবুও আমি আমার পারিবারিক অবস্থান বা তার সামাজিক, সংস্কৃতিক বা শিক্ষাগত অবস্থানের স্বার্থে, অথবা কারণে, কিছুতেই চীৎকার করে অস্বীকার করতে পারব না যে, ‘এই আমার পরিবার, এই হলো আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক। আজকাল অধিকাংশ সময়ে, শুধু মায়ের নয়, মারগটের আচরণও আমার কেমন অচেনা অজানা বলে মনে হয়। তুমি ভাবতে পার, আমি আমার বন্ধুদের ব্যবহার বা তাদের কথাবার্তার ধরণ যতটা বুঝতে পারি, তার ভগাংশও আমি আমার মাকে বুঝতে পারি না। এর চেয়ে খারাপ আর দুঃখের কিছু হতে পারে!! 

জান, আমরা যখন আমাদের বর্তমান অবস্থা আর এই অমর্যাদাকর জীবন নিয়ে আলোচনা করি, তখন আমরা সব সময় আমাদের চোখদুটোকে যুদ্ধ পরবর্তী কালে আমাদের অবস্থা কিরকম হবে, সেই সময়ের ভাবনা নিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করার চেষ্টা করি। তখন নিশ্চয়ই এখনকার মতো ভৃত্য হয়ে প্রভুর সামনে হাঁটুমুড়ে বসতে হবে না। প্রভুর ভয়ে লুকিয়ে বাঁচতে হবে না। আমাদের আশা, যুদ্ধপরবর্তী কালে, প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কটাও নতুনভাবে ব্যাখ্যাত হবে। 

প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্ক বলতে মনে পড়ে গেল, আমাদের এখানে শ্রীমতি ভ্যান ড্যানের ব্যবহার হলো, অনেকটা এক বদ- মেজাজী খেয়ালী মহিলা প্রভুর মতো, যে নিজের খেয়ালে নিজেকে চালায়। অন্যেরা তাকে অতি সহজেই একজন একরোখা বদমেজাজি প্রভু বলে ধরে নিতেই পারে। এক অদ্ভুত ধরণের মহিলা যার কোনওসময়ই আর কারুরু সঙ্গে থাকা উচিৎ নয়। তিনি নিজের সব জিনিষ, সেটা প্রয়োজনের হোক বা অপ্রয়োজনের হোক, নিজের ইচ্ছা অনুসারে অন্যের নাগালের বাইরে গোপনে সরিয়ে রাখতে ভাল বাসেন। আর তারপর কোথায় সেটা রখেছেন, সেটা অক্লেশে ভুলে যান। তারপর যখন তাঁর সেটার দরকার বা প্রয়োজন পড়ে, তখন, আমার মাকে প্রায় চীৎকার করে জিজ্ঞাসা করেন তিনি জিনিষটা কোথায় রেখেছেন! তাঁর লুকিয়ে রাখা, তারপর অক্লেশে ভুলে যাওয়া, এবং সবশেষে মাকে চীৎকার করে ভুলে যাওয়া জিনিষের হদিশ জানতে চাওয়া দেখে আমার মনে হতো, তাঁকে তাঁর ভুলে যাওয়া জিনিষের হদিশ দেওয়াটাই আমার মায়ের একটা মহান কর্তব্য। এছাড়াও, তুমি বিশ্বাস করবে না, আমি আবাক হতাম, যখন দেখতাম তাঁর জিনিষ লুকিয়ে রাখা থেকে শুরু করে (আমার হাতের বাইরে রাখার জন্যেই লুকিয়ে রাখা), সেটার হদিশ ভুলে যাওয়ার জন্যে, তার চোখে না’কি আমিই একমাত্র দায়ী ছিলাম! তিনি কিছু না কিছু ভাবে আমাকেই দায়ী করতেন। এমন কি’ তিনি মাকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন, এ’সবের জন্যে আমার মায়ের না’কি উচিৎ আমাকে ভাল করে শাসন করা। ভেবে দেখ তিনি তাঁর ছেলেকে শাসন করে উপযুক্তভাবে গড়ে তোলার জন্যে যেমন সক্রিয় ছিলেন, তেমনি, তাকে শাসন করার সাথে পরোক্ষে আমাকেও স্নেহভরে শাসন ও সাংসারিক বিষয়ে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে সমান সক্রিয় ছিলেন। সত্যিই তিনি মহীয়সী! 

তোমায় সত্যিই বলছি, ভ্যান ড্যান পরিবারটিই ছিল এ’রকম। মারগটকে তাদের শাসন করার বা বাৎসল্য পূর্ণ সাংসারিক শিক্ষাদানের কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ মারগট ছিল এমনিতেই এক শান্তশিষ্ট নিপাট “গুডী গুডী” টাইপের মেয়ে। যাকে কিছু বললেই, সে আরও মায়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ত। কিন্তু আমি ত’ সেরকম ছিলাম না। আমি ছিলাম, মারগটের একদম বিপরীত। বাচাল, জ্বালাতনকারী, তর্ক বাগীশ এক মেয়ে, যাকে কেউ যদি এক কথা বলে সে তাকে দশ কথা শুনিয়ে দেবে। তার কথা না মানলে তর্ক করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে। এ’রকম মেয়েকে শাসন করা কি চাট্টিখানি কথা? আমি তার সব কথায় প্রতিবাদ করতাম, যেটা পছন্দ হতো না, সেটা সরাসরি মুখের ওপর বলে দিতাম। 

তুমি যদি একদিন আমাদের একসাথে খাওয়ার টেবিলে দেখতে, তা’হলে বুঝতে পারতে আমার সঙ্গে ওনার কি’রকম বাদানুবাদ চলে! তুমিও বুঝতে পারতে, কেন শ্রীমতী ভ্যান ড্যান আমাকে একেবারেই পছন্দ করতে পারতেন না। আমাদের সাথে খাওয়ার টেবিলে একসাথে বসলে দেখতে, কিভাবে আমার আর ওঁর মধ্যে ক্রমাগত চলতে থাকে বাগবিতণ্ডা, কূটকচালি, তিরস্কার, এবং আমার প্রগলভ উত্তর। এসবই দেখতে। একজনের ব্যঙ্গ পূর্ণ মন্তব্য উড়ে এল, ত’ অন্য জনের কাছ থেকে হাল্কাচালে ভেসে এল, এক তীক্ষ্ণ প্রগলভ উত্তর। তবে আমার সবথেকে ভরসার জায়গা ছিল, আমার মা আর আমার বাবা। তাঁরা যে কোনও অবস্থাতেই অটল নির্ভীকভাবে সবসময় আমার পক্ষে সওয়াল করতেন। সত্যি কথা, বাবা আর মা ছিল বলেই আমি এ’ভাবে কথা বলার সাহস পেতাম। আমিও সময়ে সময়ে একবগগার মতো, আমার মা আর বাবার বিরুদ্ধে কেউ কোনও কথা বললে, তীব্র প্রতিবাদ করতাম। আমায় কেউ তখন চুপ করিয়ে রাখতে পারত না। আর একটা কথা তোমার কাছে স্বীকার করতে আমার লজ্জা নেই। আমার বাবা আর মা, সবার সামনে আমায় সাপোর্ট করলেও, আড়ালে আমায় বেশী কথা বলার জন্যে বা তর্ক করার জন্যে মৃদুভাবে হলেও, বকতেন। তাঁদের মূল কথা ছিল আমি কেন এই সব তুচ্ছ ব্যাপার, বা বড়দের কথা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখি না? সত্যি কথা বলতে, প্রতিটি বিষয়ে অহেতুক আমার নাক গলানোর প্রবণতাকে তাঁরা একদমই পছন্দ করতেন না। কিন্তু আমার অভ্যাস বল, বা ভাগ্য বল, সেটাই ছিল খারাপ। আমি কিছুতেই এই সব ব্যাপার থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারতাম না। একটা জিনিষ আমি কিছুতেই ভেবে পেতাম না, আমার স্বভাবটা কিছুতেই কেন মারগটের মতো হয় না! বিশ্বাস কর, আমি মাঝে মাঝেই ভাবি, আমার বাবা যদি এ’রকম মানুষ না হতেন, তা’হলে আমার কপালে প্রচুর দুঃখ ছিল। বাবা মার কাছে রাতদিন বকুনি খেতে হতো, আর আমাকেও সারাদিন মুখ গোমড়া করে বসে থাকতে হতো। এই দু’জন আমায় বা আমাদের দুই বোনকে শুধু ভালইবাসেন না, উপরন্তু বিশেষ করে আমার প্রচুর বেয়াদপিকেও তাঁরা হাসিমুখে মেনে নেন। হয়তঃ এভাবেই সব বাবা মায়েরা ছেলেমেয়েদের "চাল-বেচাল" সব কিছু নিজেদের মতো করেই মেনে নেন। নিজেরা শাসন করেন, কিন্তু আর কাউকে করতে দেন না। 

এই সব ভ্যান ড্যানদের মতো ডাচ মহিলাদের (১) স্বভাব কেমন জান? ধর, আমি হয়তঃ সব্জী রান্নার সময় একটু সুস্বাদু করার জন্যে তাতে দু-এক টুকরো বেশী আলু দিলাম, আর তাতেই শ্রীমতী ভ্যান ড্যানের মতো টিপ্যিক্যাল বেঁটে ডাচ মহিলার মনে হতে থাকল, এ’রকম বাজে স্বাদের তরকারী কোনভাবেই খাওয়া অন্ততঃ তার পক্ষে সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয়, সেটা অবশ্য ওনার জানা নেই। বরং তারকারীটাকে অস্বাদু বলার সাথে সাথে ওনার এটাও মনে হতে থাকল, যে, আমার মতো পাকা মেয়ে উনি না’কি জীবনে দেখেননি। সব বিষয়ে ওস্তাদি করার চেষ্টাটাই ওনার মতে আমার সবথেকে খারাপ অভ্যাস। 

আমায় সবার সামনে শাসন করার জন্যে কিংবা অপ্রস্তুত করার জন্যে, সরাসরি আমার উদ্দেশ্যে বললেন, “অ্যানি তুমি আমার কাছ থেকে একটু সব্জী নাও, দেখো আলুগুলো বেছে নিও। 

আমিও ছাড়বার পাত্র নয়। সমান শ্লেষ গলায় মিশিয়ে বললাম বা উত্তর দিলাম, “ধন্যবাদ, তার দরকার নেই। আমি যথেষ্ট সব্জী নিয়েছি, আর তার সাথে বেশ কিছু আলুও আছে। বাকীটা না'হয় আপনি নিয়ে নিন।

“আলু শুধু নয়। শরীরের পক্ষে সব্জী বিশেষ উপকারী। আমার মনে হয়, আমার এই কথার সঙ্গে তোমার মাও একমত হবেন। তাই, আলু বাদ দিয়ে, তুমি আরও কিছুটা সব্জী নাও। এই বলে তিনি আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই সব্জীর জায়গাটা আমার দিকে ঠেলে এগিয়ে দিলেন। মনে হলো যেন, ওনার নির্দেশ মতো আমার কিছুটা সব্জী নেওয়া বিশেষ জরুরী। তাই আমি ওখান থেকে যেন শ্রী মতি ভ্যান ড্যানের নির্দেশ কিছু সবজী তুলে নিই, এবং সবার সামনে ওনার এই শাসনকে অগ্রাহ্য করতে না পারি। এই রকম একটা অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থায় আমি ইদানীং পড়িনি। তুমি ভাবতে পার আমাকে রক্ষা করতে কে তখন এগিয়ে এসেছিলেন! আমার বাবা। আমার সবথেকে ভরসার জায়গা। 

আরও শুনবে? এর জন্যে আমার বাবা আর মাকে শ্রীমতী ভ্যান ড্যানের কাছে কি শুনতে হয়েছিল জান? “বুঝলে অ্যানি, তুমি যদি ছোট থেকে আমার কাছে থাকতে, অর্থাৎ আমাদের বাড়িতে থাকতে, তাহলে তুমি এ’রকম হতে না। আমি তোমায় সঠিক সহবৎ শিখিয়ে দিতাম। তোমায় মানুষ করে তুলতে পারতাম। সত্যি অ্যানি তুমি একটু বেশী রকম জেদী মেয়ে হয়ে উঠেছো। তুমি যদি আমার মেয়ে হতে, তা’হলে তোমাকে কিছুতেই এ’রকম জেদী মেয়ে হতে দিতেম না।

এই বেঁটে প্রায় স্থুল ডাচ মহিলার, আমার সম্পর্কে সর্বক্ষণের মন্তব্যের প্রথম ও শেষ কথা ছিলঃ “হতো যদি অ্যানি আমার নিজের মেয়ে!” আমার ভাগ্য ভাল, আমার কপালে এ’রকম একটা মা জোটেনি! ভাগ্যিস আমি ওর মতো মহিলার নিজের মেয়ে হয়ে জন্মাইনি। 

যাই হোক, “আমায় ভাল মতো শিক্ষাদান”, “আমার সহবৎ শেখা দরকার”, এই সব অপ্রাসঙ্গিক কথা খাবার টেবিলে ওঠার পর, বা এই সব মন্তব্য উপদেশের মতো বলার পর, কি হতে পারে বলে তোমার মনে হয়? শোন তা’হলে কি হলো, প্রথমতঃ, শ্রীমতী ভ্যান ড্যান খাবার টেবিলে কথাগুলো বলা মাত্র বা উচ্চারণ করা মাত্র, টেবিলের সবাই একেবারে নিশ্চুপ হয়ে গেল। কারুর যেন আর কিছু বলার ছিল না। কিছুক্ষণ পর আমার বাবা কথাটার সঙ্গে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে, ধীর অথচ কঠিন নিচু স্বরে বললেন, “আমার মনে হয় অ্যানি যথেষ্ট ভদ্রতা আর সহবৎ শিখেছে। এবং আমাদের পরিবারের শিক্ষায় ভদ্রতা সম্পর্কে পুরোপুরি শিক্ষিত ও মার্জিত মনোভাবের মেয়ে হয়ে উঠেছে। অন্ততঃ আমরা তাকে এই ভদ্রতা আর সহবৎ খুব ভাল করে শিখিয়েছি, যে বড়রা যখন কোনও কথা বলে বা বিশেষ উপদেশমূলক কথা বলে, তখন তা’ চুপ করে শুনতে হয়। প্রতিবাদ করতে নেই। এই শিক্ষাটা যদি না দিতাম, বা আমাদের পরিবার থেকে না পেত, তা’হলেও হয়তঃ আপনার কথার মাঝেই প্রতিবাদ করে ফেলত। কিন্তু ও’ তা’ করেনি। আর সব্জী সম্পর্কে যদি বলেন, তা’হলে আপনাকে অনুরোধ করব, দয়া করে আপনি নিজে নিজের বাটির দিকে তাকান। তাকিয়ে দেখুন, আপনি কি যথেষ্ট পরিমাণে সব্জী নিয়েছেন, না’কি বেশী আলু নিয়েছেন?” 

আমার হঠাৎ মনে হলো শ্রীমতী ভ্যান ড্যানকে কেউ যেন সজোরে চপোটাঘাত করল। এটাও মনে হলো, সঠিক সময়ে ও সঠিক কারণে শ্রীমতী ভ্যান ড্যানকে এই সপাট চপোটাঘাতটি খেতে হলো। তিনি বোধহয় এতক্ষণে খেয়াল করলেন বা করবেন, যে, তিনিও প্রায় আমারই মতো সব্জী নিয়েছেন। আর তাতে আমার মতোই আলুর পরিমাণ। আর কথা বলতে বলতে তিনি তাঁর অজ্ঞাতসারেই আলুর দিকেই হাত বাড়িয়েছিলেন, যেটা এখনও প্রায় বাড়ানোই আছে। আর তার জন্যে তাঁর শরীর বা খাবার কোনটাই খারাপ হচ্ছে বলে, তাঁর মনে হচ্ছে না। 

না, না, শ্রীমতী ভ্যান ড্যানের অবশ্য একটি আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তি আছে। আমি সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম। অতিরিক্ত সব্জী খেলে তাঁর না’কি কোষ্ঠ কাঠিন্য হয়। এটা অবশ্য আলু ব্যতিরেকে অন্য সব্জী না খাওয়ার অজুহাত হিসাবে তিনি প্রায়ই বলে থাকেন। ওনার বিরুদ্ধে এত কিছু বলার আছে, যেটা তাকে শুনতে হতে পারে; তা’হলে আমার বিষয়ে বলার ক্ষেত্রে তিনি কেন যে তাঁর মুখটাই বন্ধ রাখেন না, এ’কথাটাই আমি বুঝি না। অন্ততঃ এ’ক্ষেত্রে, বিশেষ করে আমার বাবার সামনে, যদি মুখটা একটু বন্ধ রাখতেন, তা’হলে আমায় দোষারোপ করতে গিয়ে ওনাকে এ’রকম ভাবে সবার সামনে মুখের ওপর বিব্রত হতে হতো না। আর এই রকম দুর্বল যুক্তি দিয়ে মিথ্যে মিথ্যে আত্মপক্ষ সমর্থনের বৃথা চেষ্টা করতে হতো না। অকারণে উচ্চ পরিহাসের মধ্যে তাঁর মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠত না। আমি অবশ্য ওনার এই অপমান, লজ্জায় লাল হয়ে ওঠা ইত্যাদি কোনটাকেই আমার ধর্তব্যের মধ্যে আনিনি। সেটাও তাঁর আমার প্রতি রাগের অন্যতম একটা কারণ। 

আজ এই পর্যন্ত। 

ইতি,

অ্যানি। 



অনুবাদকের সংযোজনঃ- 

(১)

নেদারল্যান্ডকে সংক্ষিপ্তভাবে ডাচ (Dutch) বলা হয়। ডাচ শব্দটির উদ্ভব জার্মান ডয়েশ্চ (Deutsh) শব্দ থেকে। তাই ডাচ শব্দের মধ্যে যেমন নেদারল্যান্ডের ব্যাঞ্জনা আছে, তেমনি আছে জার্মান সংস্কৃতির পাশাপাশি থাকার সুদীর্ঘ ইতিহাস। নেদারল্যান্ড হল্যান্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে, সপ্তদশ শতাব্দীতে স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে আত্মপ্রকাশ করে। সেই অর্থে নেদারল্যান্ডের নিজস্ব সংস্কৃতি ও জাতিগত নিজস্বতা হল্যান্ডের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত। ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত হল্যান্ড, স্পেনের অধীনস্থ ছিল। তাই নেদারল্যান্ডের সংস্কৃতির সঙ্গে, স্পেনের সংস্কৃতির একটি স্পষ্ট মিশ্রণ দেখতে পাওয়া যায়। ভিয়েনা কংগ্রেস ফ্র্যান্সের সীমান্ত অঞ্চলকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে হল্যান্ড বা ডাচকে বেলজিয়ামের সাথে যুক্ত করে দেয়। এই যান্ত্রিক সংযুক্তি হল্যান্ড বাসী বা বেলজিয়াম বাসীকে কোনভাবেই খুশী করতে পারেনি। হল্যান্ডবাসীরা প্রধানতঃ টিউটনিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, এবং তারা সংস্কারবাদী ক্যাল্ভিনপন্থী ছিল। অন্যদিকে, বেলজিয়ামে ছিল ল্যাটিন ভাষাগোষ্ঠীর লোক, ও ধর্মীয় বিশ্বাসে সনাতনবাদী ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বী। অর্থাৎ দুটি সমাজের মধ্যে সমন্বয় সাধনের কোন সহজতম পথ ছিল না। তাই সমন্বয় সাধিতও হয়নি। কৃষি ও বাণিজ্য প্রধান অঞ্চলের বাসিন্দা হিসাবে ডাচরা সামাজিক-সাংস্কৃতিক নিজস্বতার সংরক্ষণ অপেক্ষা অনেক বেশী ভরসা করত অবাধ সামাজিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময় ও বিনিয়োগের ওপর। তাই সেই অর্থে ডাচদের কোন নিজস্ব বিশিষ্ট সামাজিক সংস্কৃতিক ধাঁচা গড়ে ওঠেনি। তাদের মধ্যে জার্মানির উন্নাসিকতা সাথে বেলজিয়াম বা স্পেনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের অদ্ভুদ মেল বন্ধন ঘটেছিল। ডাচদের খাদ্য তালিকার অন্যতক উপকরণ ছিল আলু। তার সাথে তারা অন্যান্য সব্জী এবং নৈশ্যভোজের অন্তিমভাগে মিষ্টি খেতে তারা পছন্দ করত। 

প্রকৃতিগত ভাবে ডাচদের স্বভাবে কাঠখোট্টা স্পষ্টভাষিতার প্রবণতা ছিল স্পষ্ট। শ্রীমতী ভ্যান ড্যানকে দেখে বা অ্যানির বর্ণনা শুনে মনে হয়, তাঁর স্বভাবও ছিল কাঠখোট্টা মার্কা। শ্রীমতী ভ্যান ড্যান মুখের ওপর অপ্রিয় কথা বলতে বা মনের মতো মুখের ওপর স্পষ্ট জবাব দিতে বেশ দড় ছিলেন। তবে শ্রীমতী ভ্যান ড্যানের প্রতিটি কথার মধ্যে কিছু না কিছু উদ্দেশ্য থাকতই। এরকমই, অ্যানিকে সবার সামনে যে কোন অজুহাতে ঠাট্টা করা বা কথার প্যাঁচে বিব্রত করাই ছিল তাঁর অপর এক উদ্দেশ্য । 

ডাচ মহিলা সম্পর্কে বলা হয়, তারা যতই কটু কথা বলুক না কেন, কোন ভাবেই তাদেরকে অমিশুকে বলা যায় না। তবে কোন ডাচকে যদি বলা হয়, আপনি অত্যন্ত কর্কশ ব্যবহার করছেন, তা’হলেও তারা তার প্রতিবাদ না করে সম্পূর্ণ উদাসীন নৈব্যাক্তিক দৃষ্টিভঙ্গী সহ সেই সমালোচনাকে গ্রহণ করে নেবে। তাদের যে কোন কথাই সরাসরিভাবে রাখঢাক না করেই বলে দেওয়াটাই অভ্যাস। আর এটাকে কেউ সমালোচনা বা দোষারোপ করলেও, তারা তাদের অচরণের কোন পরিবর্তন করতে চায় না। কারণ তারা মনে করে, এই সরাসরি বলে দেওয়াটা তাদের একটা ভাল অভ্যাস বা গুণ। তাই সেটা পাল্টানোর কোন চেষ্টাই তারা করে না। এই ডাচ-সুলভ গুণগুলি বা বৈশিষ্ট শ্রীমতী ভ্যান ড্যানের মধ্যেও ছিল। আর এই কারণেই তাঁর মধ্যে অ্যানির বিষয়ে কোন না কোন সময়ে কিছু না কিছু মন্তব্য করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

0 comments: