Next
Previous
Showing posts with label ধারাবাহিক. Show all posts
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২০ (১)

বদ্রী পালোয়ান গেছে পড়শি জেলায় এক নওজোয়ানের জামিনের তদ্বিরে। ছেলেটির উপর ধর্ষণ ও মারপিটের মামলা শুরু হয়েছে। যাবার আগে রঙ্গনাথকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল—ব্যাটা মহা গুণ্ডা! যেখানে যায় একটা না একটা ঝঞ্ঝাট বাঁধিয়ে ছাড়ে।

তারপর বৈদ্যজীর থেকে দেড় হাজার টাকা নিয়ে জহরকোটের ভেতরের পকেটে ঠুঁসল। রঙ্গনাথের কৌতুহল—“এতগুলো নগদ টাকা এমন ভাবে নিয়ে যাওয়া”!

বদ্রীর জবাব,” গুণ্ডা শুধু এজলাসের নীচে কাঠগড়ায় নয়, উপরেও বসে রয়েছে।হাকিম তো তা-না-না-না করে জামিন দিয়ে দেবেন। কাগজ চলে যাবে কর্মচারিদের হাতে। তারপর বিশ রকম ঝামেলা। জামিনের উপযুক্ত কাগজ কই? কাগজ তৈরি কর। সম্পত্তির নকশা নিয়ে এস। তারপর সেটার যাচাই করা—কাঁচা এবং পাকা—সব হবে। এবং পদে পদে পয়সা ঠেকাতে থাক।

“ যারা ভাল মানুষ তারা জামিনের চক্করে না ফেঁসে জেলে পড়ে থাকা পছন্দ করে। নগদ নারায়ণের ব্যাপারই আলাদা—বড় আরাম। যেই হাকিম হেঁকে বলবে—একহাজার টাকার জামিন!

অমনই দশটা সবুজ কড়কড়ে নোট টেবিলে ছুঁড়ে দিয়ে বলব—নাও ভাই! রেখে দাও যেখানে তোমার ইচ্ছে”।

রঙ্গনাথ আরও জানতে চাইছে-“ বদ্রী দাদা, ব্যাটা যখন একনম্বরের গুণ্ডা তখন কেন হাত ময়লা করছ? পচুক না ব্যাটা জেলে”!

“ গুণ্ডা কে নয়? রঙ্গনাথ বাবু, ভেবে দেখ—গুণ্ডার মাথায় কী শিং বেরোয়”?

তারপর ধীর স্বরে বলল—“ আমি খালি এইটুকুই জানি যে ব্যাটা কখনও আমার আখড়ায় চ্যালাগিরি করেছিল। বাইরের লোকের চোখে ও যত বড় গুণ্ডাই হোক, আমার চোখে ওইদিন ভাসে যখন কুস্তির আখড়ায় ও আমার ল্যাং খেয়ে ছিটকে পড়ত”।

এবার ওর গলার স্বর আরও কোমল হয়ে খাদে নেমে এল,”যাই বল, আমারই তো পোষ্যপুত্তুর বটে”!

পোষ্যপুত্তুর শব্দের অমন লাগসই প্রয়োগ দেখে রঙ্গনাথ ভির্মি খেল। তবে ওর মাথায় একটা রিসার্চ পেপার লেখার চিন্তা ঘাই মারল—‘আধুনিক ভারতে পোষ্যপুত্তুরের মহত্ত্ব’।

“এই সেদিনও আখড়ায় এসে কাঁইচি মারা শিখছিল, এখন তো পুরোদস্তুর পালোয়ান”! বদ্রীর গলায় আবেগের ছোঁয়া।

রঙ্গনাথ বুঝতে পারল যে সব পোষ্যপুত্তুরের ক্যারিয়ার এভাবেই শুরু হয়।

প্রত্যেক মহাপুরুষের আশে পাশে পোষ্যপুত্তুরদের ভীড় লেগেই থাকে। পুরুষ মহাপুরুষ হয়ে গেলেই তাঁর সম্মান রাখার দায়িত্ব পোষ্যপুত্তুরদের ঘাড়ে এসে পড়ে। ওরা ওনার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেয়। কিছুদিন গেলে ওই ইজ্জত ফেটে গিয়ে সহস্রধারায় বয়ে চলে।লোকসভা বিধানসভার বিতর্কে সেই ধারায় ভেসে যায়। খবরের কাগজ আর বেতারে তার ছিঁটে পড়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়। সেই ধারায় পুরো গণতন্ত্র ডোবে আর ভাসে। শেষ হয় বেহায়াপনার মহাসাগরে লীন হয়ে।

বদ্রী পালোয়ান ব্যাখ্যান করতে শুরু করলঃ

“ঝগড়ার শুরু পড়শি এক বামুনকে নিয়ে---“

--- মহাপুরুষেরা সাধারণতঃ নিজের সিংহাসনে বসে পোষ্যপুত্তুরদের খেলাধুলো দেখতে থাকেন। এই দেশে মহাপুরুষ আর তাঁর পোষ্যপুত্তুর ছাড়া কিছু ঝামেলা পাকানোর লোকও থাকে। তারা কখনও সখনও মহাপুরুষের সামনে এসে চেঁচায়—“ ওগো মহাপুরুষ, তোমার পুষ্যিদের ভ্রষ্টাচার আর দুর্নীতির চোটে টেকা দায়। বড্ড বাড় বেড়েছে। তোমার ইজ্জত পাংচার হল বলে”।

এমন সময়ে মহাপুরুষেরা একটিই কাজ করে থাকেন।

“ কী বলছেন, ভ্রষ্টাচার! আসুন, আমরা সবাই মিলে আগে ঠিক করি ভ্রষ্টাচার কাকে বলে? তার সজ্ঞা কী”? রঙ্গনাথের চিন্তার স্রোত বয়ে চলে।

“তো পড়শি এক বামুন। ওর বৌয়ের ভরা যৌবন”।

ব্যস্‌, ওইটুকু শোনামাত্র রঙ্গনাথ তার ‘আধুনিক ভারতে পোষ্যপুত্তুরের মহত্ত্ব’ গোছের থিসিসের কথা ভুলে মনপ্রাণ দিয়ে বামুনের পারিবারিক কেচ্ছা শুনতে লাগল।

“--- আমার চ্যালা তার কাছেপিঠে কোথাও থাকত। বামুন-বৌয়ের সঙ্গে কয়েক মাস ওর ইন্টুমিন্টু চলছিল। বামুন সব জেনেও না দেখার ভান করত। একদিন হল কি, পর্দার আড়ালও রইল না। বামুন ফ্যালফ্যাল করে দেখল যে আমার চ্যালা ওর বৌকে জাপটে ধরেছে। কিন্তু সে ব্যাটা খানিক চোখ মিটমিট করে থলের মত চেহারা করে চুপচাপ কেটে পড়ল। এতে আমার চ্যালার হল মটকা গরম। ওর মন পরিষ্কার, বেশি জিলিপি প্যাঁচানো পছন্দ নয়। একলাফে এসে বামুনের ঘাড় ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল—কিঁউ বে, আমার সামনেই কেটে পড়ছিস, লাজ-লজ্জার মাথা খেয়েছিস? মরদ ব্যাটা, তোর একটু রাগও হল না? আরে সত্যিকারের মরদ হলে একবার আমাকে আওয়াজ দিয়ে দেখতিস্‌!

“ তো বামুন বেচারা করবেটা কী! মন্তর গোছের কিছু ফিসফিস করে আউড়ে দিল। তাতে খেপে গিয়ে আমার চ্যালা হাসিমুখে ওকে এক কাঁইচি মেরে চিৎ করে দিল। বেচারার ঊরুর হাড় গেল ভেঙে।

“তারপর চেঁচামেচি কান্নাকাটি সব শুরু হল। বামুন এবার গলা ফাটিয়ে চেল্লাতে লাগল। আবার ওর বৌ চিল-চিৎকার জুড়ল—দেখ দেখ, লোকটা আমার ইজ্জত লুটে নিচ্ছে।

এবার তুমিই বল রঙ্গনাথ বাবু, এই দুনিয়ায় কার শত্রু নেই? এতেই থানায় রিপোর্ট লেখানো হল আর আমার চ্যালা ফেঁসে গেল”।

বদ্রী পালোয়ান হাসতে লাগল, যেন খুব মজার কথা শুনিয়েছে।

রঙ্গনাথ –“কিন্তু বদ্রী দাদা, এটা কেমন হল? ----- আগে বেচারার বিবিকে --- তারপর ওকেও”--?

বদ্রীর হাসি থামছে না। “ রঙ্গনাথ বাবু, তুমি মুখ ফুটে বল, বা না বল—এটাই সত্যি। যে নিজের বৌকে সামলাতে পারে না , সে সারাজীবন বেচারাই থাকে। ওকে নিয়ে হা-হুতাশ করে কী হবে? আমার মাথাব্যথা নিজের চ্যালাকে নিয়ে”।


বদ্রী পালোয়ান ক’দিনের জন্য বাইরে যাওয়ায় রঙ্গনাথ আজ ছাতে একলাই শুয়েছে । শীত জাঁকিয়ে পড়েছে। শীতের মজা উপভোগ করবে বলে বদ্রী ওর খাটিয়া খোলা ছাতে লাগিয়ে শুচ্ছিল, রঙ্গনাথ ঘরের ভিতর।

রাত প্রায় এগারোটা। ওর ঘুম আসছে না।

খাটিয়ার পাশে একটা কাঠের বাক্সোর উপরে একটি ব্যাটারিতে চলা রেডিও রাখা। কাঠের বাক্সটিতে কলেজের জন্য বইপত্তর এসেছিল। বইপত্তর গেল প্রিন্সিপালের ঘরে আর বাক্সটা মেরামতের পর বৈদ্যজীর ঘরে। রেডিওটা কলেজের। তবে রঙ্গনাথ আসার পর কলেজ থেকে চেয়ে আনা হয়েছে। ওটা আসার পর রূপ্পনবাবুর ম্যাজিক বা কানে লাগিয়ে স্থানীয় রেডিও স্টেশন থেকে আবহাওয়ার খবর শোনার হেডফোনটা ফালতু হয়ে গেল। রেডিও সারাদিন বেজে চলে—সে ঘরে কেউ থাকুক বা না থাকুক। তবে রাতের কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম।

এ’সময় রেডিওতে শাস্ত্রীয় সংগীতের কোন প্রোগ্রাম তার শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ছিল, এবার যেন দাঙ্গা শুরু হল। ভায়োলিন আর তবলা একে অন্যের উপর ঘন্টায় দুশো মাইল বেগে হামলা করছে। মনে হচ্ছে, ওদের দুই গাড়ি সংঘর্ষের ফলে ক্র্যাশ করে টুকরো টুকরো হল বলে। চারদিকে হাহাকার। হঠাৎ ভায়োলিন বাদক তার পাতলা তারে একটা ‘কিরররররর—‘ ধ্বনি বের করল, রঙ্গনাথের কলজে যেন বল্লমের খোঁচায় এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল! তক্ষুণি তবলায় যেন বোমা ফাটল। তাতে সঙ্গীত-নাটক-অ্যাকাডেমির ভবনের ভিত নড়ে উঠল। রঙ্গনাথ লাফিয়ে উঠে দেখতে লাগল—রেডিও আস্ত আছে তো?

নাঃ, সেটা ক্যাসাবিয়াংকার মত নিজের কাজে অচল অটল। সমানে সঙ্গীত জগতের কোস্তাকুস্তির ধারাবিবরণী দিয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে, এবার ভায়োলিন ল্যাজ গুটিয়ে পালাচ্ছে আর তবলার হামলায় আরও জোশ এসে গেছে। রঙ্গনাথ ক্লান্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে রেডিওর কান মলে দিল।

ঘন অন্ধকার! শীতের রাত তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে আবির্ভুতা। এ’রম সময়ে লোকের মনে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস হোক বা না হোক, ভূতের বিষয়ে বিশ্বাস জন্ম নেয়। রঙ্গনাথ ভয় পায়নি, কিন্তু ওর কেমন যেন লাগছে, অদ্ভুত কোন অনুভূতি। সত্যি বলতে গেলে এসব ভয় পাওয়ারই লক্ষণ।

কিন্তু ভয়ের চিন্তা ফিকে হয়ে গেল। কারণ, রঙ্গনাথ এখন রেডিও থেকে রূপ্পন বাবু, ফের রূপ্পন বাবুর থেকে বেলা নামে এক মেয়ের কথা ভাবছে। যাকে কখনও চোখে দেখেনি, কিন্তু কানাঘুষোয় শুনেছে যে রূপ্পনবাবু নাকি ওকে প্রেমপত্র লিখেছে!

ও জানেনা যে সেই প্রেমপত্রটি কত লম্বাচওড়া, আর কতটা গভীর। তবে গুজব হল—সেই চিঠির বাক্যগুলো নাকি অনেকগুলো সিনেমার গানের লাইন জুড়ে তৈরি। পাড়ায় বলাবলি হচ্ছে যে বেলার পিসি প্রথম সেই লাভ লেটার ঘরের এক কোণায় পড়ে থাকতে দেখে। তারপর সেটা বেলার বাবা গয়াদীনের সামনে পড়া হয়। গোড়ায় দু’একটা লাইন থেকে গয়াদীনের কিছুই বোধগম্য হয়নি।

কিন্তু তারপর এল এই লাইনটি-‘মুঝকো আপনে গল্লে (গলে) লাগালো ও মেরে হমরাহী’। এটা পড়ামাত্র গয়াদীনের জ্ঞানের কপাট ধড়াম করে খুলে গেল। বোঝা গেল এই অনুরোধ কেউ বেলাকে করেছে। চিঠির শেষ লাইন অব্দি পৌঁছতে পৌঁছতে এটার আসল চেহারা স্পষ্ট হয়ে গেল। কারণ, তাতে বলা হয়েছে—“ ইয়ে মেরা প্রেমপত্র পড়কর কি তুম নারাজ ন হো, কি তুম্মেরি জিন্দগী হো, কি তুম্মেরি বন্দগী হো”। লেখকের নাম “শ্রী রূ”।

শোনা গেছে, চিঠিটা গয়াদীন ছাড়া শুধু প্রিন্সিপাল সাহেবই দেখেছেন। তার কারণ গয়াদীন গিয়ে রূপ্পনবাবুর নৈতিক অধঃপতনের সঙ্গে, কেন যেন, প্রিন্সিপালের নামও জুড়ে দিয়েছেন। প্রিন্সিপাল ওনাকে বোঝাতে চাইলেন যে লেখাটা কোন লাভ লেটার নয়, বরং বেশ উঁচু স্তরের কাব্যসংগ্রহ। আর সেটার লেখক ‘শ্রী রূ’ হলেও তাতে কাব্যগুণ কিছু কম হয়নি। কিন্তু ভবি ভোলেনি। গয়াদীনের মতে এগুলো নোংরামির প্রমাণ। তারপরে প্রিন্সিপাল বেশ কিছু কবিতার লাইন শুনিয়ে বোঝাতে চাইলেন যে সাহিত্যে এমন সব উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি রয়েছে। তখন গয়াদীন চটিতং হয়ে বললেন—ওইসব কবিতার লাইন তোমার চরিত্র-দোষের প্রমাণ। শেষে দু’জনে মিলে ঠিক করলেন—ওই চিঠির কথা আর কাউকে জানানো হবে না।

পরের দিন থেকেই শিবপালগঞ্জের হাওয়ায় নানারকম খবর উড়ে বেড়াতে লাগল।

একটা খবরঃ খান্না মাস্টারের দলের কোন ছোঁড়া বেলাকে প্রেমপত্র লিখেছে, কিন্তু মিছিমিছি রূপ্পনবাবুর নাম জুড়ে দিয়েছে।

দ্বিতীয় খবরঃ বেলা রূপ্পনবাবুকে চিঠি লিখেছে। রূপ্পন তার জবাব দিইয়েছেন, কিন্তু সেটা গয়াদীনের হাতে পড়ায় ইজ্জতে গ্যামাক্সিন হয়ে গেছে।

তৃতীয় খবরঃ বেলা একটি খারাপ মেয়ে। --এই গল্পটাই বেশি প্রসিদ্ধ হল।

(চলবে)
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in








নোবেল জয়ী হান কাং-এর লেখায় টুকরা টুকরা রক্তাক্ত জগৎ




প্রিয়বরেষু
বাসু,

তোমার চিঠি যখন হাতে পেয়েছি দোল পূর্ণিমার রঙ তখন আমার মর্মে লেগে আছে। কর্মব্যস্ত জীবন থেকে কয়েকটা দিন চুরি করে শান্তিনিকেতন কাটিয়ে এলাম। খুব চেয়েছিলাম তুমি আসো চুটিয়ে আড্ডা দেই তোমার সাথে। তুমি তো এলে না, হয়ত সত্যিই অসুস্থ ছিলে কিংবা নিছক অসুস্থতা দেখিয়ে এড়িয়ে গেলে। ভালোই হলো মুখোমুখি হলে হয়ত অতীতের অনেক কবর চাপা কথা জেগে ওঠতো। তোমার শরীর এখন কেমন? সুভাষ ডাক্তারকে তো সেই ছোটবেলা থেকেই দেখাচ্ছো এবার অন্য একজন ডাক্তার দেখাও। প্রায়শ তোমার অসুস্থতার কথা শুনি এত ঘনঘন অসুস্থতা ভালো লক্ষণ নয় মোটেই।

হারুকি মুরাকামি আমার প্রিয় লেখকদের একজন। তার লেখা আমাকে খুব ভাবায়। সম্প্রতি ইজরাইলি গল্পকার, স্ক্রিপ্টরাইটার ও ফিল্মমেকার এটগার কেরেটের লেখাও আমার বেশ প্রিয়। ২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার হান কাং কে তুমি কি পড়েছো? মানুষের জীবনের ভঙ্গুরতা, যন্ত্রণার কথা বার বার হানের কলমে উঠে এসেছে আর গদ্য হয়ে উঠেছে কবিতা। ফুটপাতে পুরানো বই ঘাঁটতে গিয়ে আমার হাতে আসে ২০১৬ সালে ডেবোরো স্মিথের অনুবাদে ইংরেজিতে হান কাংয়ের লেখা সবচেয়ে জটিল চিন্তার অভিনব উপন্যাস 'হিউম্যান অ্যাক্ট' যা 'সোনানিয়ন ওন্দা' নামে প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। তখন থেকে আমি হানের লেখার সাথে পরিচিত কিন্তু এত জলদি সে নোবেল পাবে ভাবিনি।

হিউম্যান অ্যাক্টস লেখা হয়েছে দ্বিতীয় পুরুষের বর্ণনায়। ইতিহাসভিত্তিক এ উপন্যাসের ভাষা আদতে কাব্যিক। ছয়টি অধ্যায় আর শেষে উপসংহার নিয়ে মোট সাত খণ্ডের উপন্যাসটিতে আছে চুন ডু হুয়ান নামের এক সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী কিশোরের গল্প। স্কুলপড়ুয়া কিশোর দং হো ১৯৮০ সালের মে মাসে জড়িয়ে পড়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দানা বাধা গণতন্ত্রকামীদের আন্দোলনে। পরবর্তী অধ্যায়গুলোয় পাল্টে যায় পরিপ্রেক্ষিত। জেয়ং দে নামের আরেক নিহত কিশোরের বয়ানে এগোতে থাকে কাহিনি। পড়তে পড়তে কারও মনে পড়তে পারে ওরহান পামুকের মাই নেম ইজ রেড–এর কথা। এখানে নামহীন লেখকের চরিত্রটি হতে পারেন হান কাং নিজেই, যিনি গোয়াংজু অভ্যুত্থানের কিশোর শহীদ দং হোর কবরে মোমবাতি জ্বালিয়ে সম্মান জানিয়ে আসেন। তারপর সিউলে ফিরে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে। হানের হিউম্যান অ্যাক্ট পড়তে শুরু করে আমি রীতিমত অবাক হয়েছিলাম। বইটির প্রেক্ষাপটের সঙ্গে আমাদের নকশাল আন্দোলন কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। ১৯৮০ সালে কোরিয়ার গোয়াংজুতে সংঘটিত গণতান্ত্রিক আনন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে এই উপন্যাসের কাহিনি। সেসময় ঘটনাচক্রে আন্দোলনে যোগ দেয় উপন্যাসটির মূল চরিত্র স্কুল শিক্ষার্থী ডংহো। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন দমন করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী চরম নিপীড়ন চালায়। আন্দোলনকারী অনেক ছাত্রকে তারা হত্যা করে। স্কুল শিক্ষার্থী ডংহো এরকম বেশ কিছু মৃতদেহ উদ্ধার করে এবং তাদের লাশের উপর দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা বিছিয়ে দিতে দেখা যায়। যদিও বিক্ষোভকারীদের বেশিরভাগই ছিল ছাত্র এবং ডংহোর বয়স ছিল সবার চেয়ে কম, তবুও স্বৈরাচারী শাসকের নিপীড়নের উপর বিশ্বাস করা ছিল কঠিন। ডংহোর মা উদ্বিগ্ন অবস্থায় দিন কাটাতে থাকে।

সেসময় আন্দোলনকারীদের ধরতে রাতের বেলা রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে অভিযান চালাতে দেখা যায়। স্কুল ছাত্র ডংহোর সবচেয়ে কাছের বন্ধু জিয়োংকে তার চোখের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। হপ্তাখানেকের মাঝে জিয়োংয়ের বোন জিয়োংমি নিখোঁজ হয়। এমতাবস্থায় সেই এলাকায় রাতে অভিযান করার জন্য আসে বাহিনী। ডংহোর মা তাকে রাতে বাসায় না ফেরার জন্য বলে, কারণ ডংহোকে অভিযান করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মা উদ্বিগ্ন থাকে। উপন্যাসটি লেখক ডংহোর মৃত বন্ধু জিয়োংয়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্ণনা করা শুরু করে। সেখানে দেখা যায়, জিয়োং একটি লাশের স্তুপের মাঝে পরে আছে এবং সে বুঝতে পারছে তার নিখোঁজ বোন জিয়োংমিকেও সম্ভবত মেরে ফেলা হয়েছে। সে তার জীবিত বন্ধু ডংহোকে নিয়ে ভাবে এবং এসব হত্যাকান্ডের শাস্তি একসময় স্বৈরশাসক পাবে তার আশা ব্যক্ত করতে থাকে। ঠিক সেসময়ই সে বুঝতে পারে একদল রাষ্ট্রীয় বাহিনী এসেছে লাশের স্তুপের কাছে, জনগণ থেকে লুকাতে তারা লাশগুলো পুড়িয়ে দিতে চায়। হানের এই লেখা পড়তে পড়তে আমার নকশাল আন্দোলনের শোনা গল্পগুলোর কথাই মনে পড়তে থাকে।

তোমার নিশ্চয়ই পরাগ মিত্রের কথা মনে আছে। যার কাছে নকশাল আন্দোলনের গল্প শুনতাম আমরা। কমরেড কাকার কাছেও বহু ইতিহাস আমরা শুনেছিলাম। তাঁর মুখেই শোনা সেইসময় নকশালবাদে যোগদানের জন্য অনেক ছাত্র কলেজ পর্যন্ত ছেড়েছিল। চারু মজুমদার ছাত্রদের নকশাল আন্দোলনে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, এই বিপ্লব শুধুমাত্র গ্রামীণ জনগণের জন্য নয়, বরং যারা ‘শ্রেণী শত্রু’ তাদের বিরুদ্ধে লড়াই। এই শ্রেণী শত্রুর তালিকায় পড়বে সরকার থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, পুলিশ এবং আরো অনেকে। নকশালপন্থীরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নেয়। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স নকশাল কার্যকলাপের জন্য অন্যতম ঘাটি হয়ে ওঠে। নকশালবাড়ি আন্দোলন বছরখানেকের মধ্যে অনেকটা স্তিমিত হয়ে এলেও অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, আজ পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পরও সেই আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা এবং তাৎপর্য বিন্দুমাত্র হারিয়ে যায়নি। এটি স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসকে আমূলভাবে বদলে দিয়েছে। নকশাল আন্দোলন নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস-গান-কবিতা লেখা হয়েছে। সমরেশ মজুদারের ‘উত্তরাধিকার’-এর চার প্রধান চরিত্র নকশালবাদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়। বুকার পুরষ্কারজয়ী লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য গড অফ স্মল থিংস’-এর একটি চরিত্র নকশাল আন্দোলনে যোগ দেয়। মহেশ্বেতা দেবী তার ‘হাজার চুরাশির মা’ এই আন্দোলনের পটভূমিতেই লেখেন। পরে একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ঝুম্পা লাহিড়ী, অনুরাগ মিশ্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ আরো অনেকের লেখনীতে নকশাল আন্দোলন বারবার উঠে এসেছে।

হান কাংয়ের লেখা কেমন? কী তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়? মূল ভাষার সৌন্দর্য বোঝার মুরোদ আমার নেই, তাই তাঁর অনুবাদক ডেবরা স্মিথের অনুবাদই ভরসা। তবে হিউম্যান অ্যাক্ট পড়ার পরে আমি খুঁজে খুঁজে তার অন্য উপন্যাসগুলো পড়েছি এবং পড়ার পরে মনে হয়েছে হান কাংয়ের লেখার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাহুল্য বিবর্জিত লেখা। কলেবরের জায়গা থেকে অতি সংক্ষেপিত এবং মাত্র চারটি উপন্যাস লিখেই নোবেল জিতে নিয়েছেন তিনি। পৃষ্ঠার হিসেবেও সেটা ৬০০ থেকে কম। আমাদের পরিচিত অনেক লেখকের একটি উপন্যাসের চেয়ে কম, হান কাংয়ের সারাজীবনের গদ্য। চাইলে গোটা হান কাং পড়ে ফেলা যায় এক সপ্তাহে। বাহুল্য বিবর্জিত স্পষ্ট অথচ জটিল চিন্তার এই লেখাগুলোর দ্বারা দক্ষিণ কোরিয়ান কাব্যময় লেখার ভঙ্গিমায় হান কাং আমাদের নিয়ে যায় এমন এক জগতে, যেখানে বাস্তবতার ভয়াবহতা টের পাওয়া যায় ক্রমেই। মৃত লাশের মনে হতে থাকে জীবিত নিপীড়নের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, অথচ আমাদের মনে হয়েছিল মৃত্যুই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।

হান কাংয়ের উপন্যাস ‘দ্য হোয়াইট বুক’ র পটভূমি হিসেবে এসেছে যুদ্ধ-পরবর্তী পোল্যান্ডের ওয়ারশ। নিরস্ত্র কথকের ছোট বোনের মৃত্যু সম্পর্কে খণ্ড খণ্ড চিন্তামগ্নতা নিয়ে তৈরি হয়েছে এই উপন্যাসের কাহিনি। জন্মের দুই ঘণ্টা পর মৃত্যু হয় শিশুটির। ‘দ্য হোয়াইট বুক’ উপন্যাসের উপস্থাপনশৈলীর মধ্যে নতুনত্ব লক্ষ করা যায়। দুঃখ, ক্ষতি এবং মানবাত্মার ভঙ্গুরতার কথা বলার জন্য ভাত, চিনির খণ্ড এবং বুকের দুধসহ মোট ৬৫টি সাদা বস্তুর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এখানে। এখানে উপস্থাপিত কাহিনির সঙ্গে লেখকের বাস্তব জীবনের অনেক মিল পাওয়া যায়, বিশেষ করে তাঁর বোনের শিশুবেলার মৃত্যুর সঙ্গে। হান কাংয়ের আরেক উপন্যাসের নাম ‘গ্রিক লেসনস’। উপন্যাসে বাকশক্তি হারানো একজন নারী প্রাচীন গ্রিক ভাষা পাঠ করার সিদ্ধান্ত নেয়। যার কাছে পাঠ নেবে তারও অবস্থা ওই নারীর মতোই: ধীরে ধীরে সে দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকে।
তবে এ উপন্যাসে দেখানো হয়েছে, ভালোবাসার প্রায়শ্চিত্তমূলক শক্তির মধ্যে আশাবাদী ও মানবীয় বিশ্বাস নিহিত থাকে। কারণ তাদের পাঠদান ও পাঠগ্রহণের প্রক্রিয়ায় পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। একজন আরেকজনের মানসিক যন্ত্রণা ও দুশ্চিন্তার কথা জানতে পারে, অনুভব করতেও পারে। পর্যায়ক্রমে তারা আরো নিকটবর্তী হতে থাকে। ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের পর হান কাংয়ের এই উপন্যাস বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ইতিবাচক সাড়া পায়।

এই সবগুলোই হয়ত তোমার পড়া কিন্তু আমাকে অবাক করেছে ১৯৭০ সালের শেষে জন্ম নেয়া হান কাং লেখালেখি শুরু কবিতার মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে। একটি সাহিত্য ম্যাগাজিনে ছাপা হয় তার পাঁচটি কবিতা। পরের বছর ঔপন্যাসিক হিসেবে অভিষেক হয় তার। তিন দশকের লেখালেখিতে আন্তর্জাতিকভাবে তিনি নজরে আসেন অনেক পরে। ২০০৭ সালে প্রকাশিত 'দ্য ভেজেটেরিয়ান' উপন্যাসটি ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। হিসেব করলে হান কাংয়ের আন্তর্জাতিক পরিচিতি মোটের উপর দশ বছর। এত কম সময়ের পরিচিতিতে নোবেল পুরস্কার জেতার ঘটনা আগে সেভাবে ঘটেনি। তার উপর এবারে নোবেল প্রত্যাশী যেসব লেখকদের নাম সামনে আসছিল, হান কাং তাদের মেয়ের বয়সীই হবে। এর বাইরেও মজার একটি বিষয় হলো, ২০১২ সাল থেকে (কাজিও ইশিগুরো ব্যতিরেকে) এক বছর পরপর সাহিত্যে নারী লেখককে নোবেল জিততে দেখা যায়। ২০২৪ সালের নোবেলেও এই ধারাবাহিকতা দেখা গেল। সব মিলিয়ে এবারের সাহিত্যের নোবেল বেশ অদ্ভুতই বটে। তুমি হান কাংয়ের কি কি পড়েছো জানিও। তুমি আরো গভীরভাবে হান কাংয়ের লেখার বিশ্লেষণ করতে পারবে আমি জানি।

হান কাংয়ের দ্য ফ্রুট অব মাই উওম্যান উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে একটা অভিনবত্ব চোখে পড়ে মোট আটটি কাহিনির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এ উপন্যাস। এখানকার ভিন্ন ভিন্ন পর্বে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যর্থতার চিত্র দেখানো হয়েছে। বেশির ভাগ জায়গায় তারা জীবনে কোনো আশা দেখতে পায় না। ‘মাই উওম্যান’স ফ্রুট’ অংশে হতদরিদ্র জেলেপল্লীতে জন্ম নেওয়া এক নারীর কথা বলা হয়েছে। নিজের চেষ্টায় সে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে যেতে চায়। তবে তার বিশ্বাস হলো, জগতের রূপ দেখতে হলে বিয়ে করাও দরকার। সে জন্য স্বামীর সঙ্গে আগে সংসার পাতে সে। কিন্তু কিছুদিন পর তারা একে অন্যের প্রতি আর টান অনুভব করে না। এক পর্যায়ে স্বামীর কাছ থেকে দূরে কোথাও পালিয়ে পাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। তারপর সে গাছ-লতা হয়ে ঘরের ছাদ পেরিয়ে যাওয়ার কথা কল্পনা করে। এ উপন্যাসে দেখানো হয়েছে মানসিক ক্লান্তি আর আধুনিক জীবনের নিরাশা পেরিয়ে যাওয়ার মতো মানুষের ইচ্ছাশক্তি থাকার বিষয়। তবে দ্য ফ্রুট অব মাই উওম্যান গল্পটির ভাবকাঠামোর পরিশীলিত রূপান্তর ঘটিয়ে দীর্ঘ দশ বছর পর ২০০৭ সালে এই গল্পটিকেই তিনি দ্য ভেজিটারিয়ান উপন্যাসে রূপ দেন। এক নারীর নিরামিষাশী হওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে পারিবারিক সংকট আর সামাজিক নিষ্ঠুরতার গল্পকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে দ্য ভেজিটারিয়ান। এটি লিখতে তিনি তিন বছর সময় ব্যয় করেন। এটির কেন্দ্রীয় ও নারী চরিত্রকে ঘিরে গড়ে ওঠা অন্যান্য চরিত্রের পটভূমি এবং গাছপালা ও সূর্যকিরণের চিত্রকল্পের আবহ তৈরির জন্য তিনি অনেক ভাবনাচিন্তা ও পর্যবেক্ষণ করে মাসের পর মাস খেটে উপন্যাসটি সমৃদ্ধ করেন। দ্য ভেজিটারিয়ান তিনটি পর্বে বিভক্ত। ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে অসুস্থ হওয়ার পর মাছ–মাংস খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইয়েয়ং হাই নামের এক বিবাহিত নারী। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে তার স্বামী চেইয়ং দেখতে পায় ফ্রিজ থেকে সব প্রাণিজ আমিষ খাদ্য ফেলে দিচ্ছে সে। নিজে নিরামিষভোজী হয়েই ইয়েয়ং ক্ষান্ত নয়, স্বামীর জন্যও মাছ–মাংস রাঁধতেও সে অস্বীকৃতি জানায়। শান্তভাবে বলে যে দিনের মধ্যে দুই বেলাই যেহেতু চেইয়ং বাইরে খাওয়াদাওয়া করে, তাই এক বেলা নিরামিষ খেলে তার এমন কিছু ক্ষতি হবে না। উপন্যাসের প্রথম পর্বে ইয়েয়ংয়ের ভেজিটারিয়ান হওয়া নিয়ে অস্বস্তি, যা ক্রমে পারিবারিক সংকট, অতঃপর সংঘাতের রূপ নেয়—সেটুকু ইয়েয়ং হাইয়ের স্বামী চেইয়ংয়ের বয়ানে, সোজাসাপটা ভাষায় লেখা। মাঝেমধ্যে কেবল কিছু অংশ লেখা হয়েছে ইটালিকে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, সেগুলো ইয়েয়ং হাইয়ের স্বপ্নের বিবরণ। তাতে যত না কাব্য, তার চেয়ে বেশি আছে ভয়ানক সব নৃশংসতার চিত্র। রক্তাক্ত, বীভৎস সেই সব দুঃস্বপ্ন ইয়েয়ংকে ভয়ানকভাবে তাড়া করে। স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠার পর প্রাণী হত্যা আর মাংস ভক্ষণের পুরো প্রক্রিয়াটি অস্বাভাবিক নিষ্ঠুর বলে মনে হয় তার কাছে। যদিও প্রতি বেলা মুরগি, গরু, শূকর, অক্টোপাসসহ নানা ধরনের মাছ–মাংস সব সময়ই ছিল তাদের খাদ্যতালিকায়। ইয়েয়ং হাই নিজে খুব ভালো রাঁধুনি। ছোটবেলায় মায়ের কাছে প্রায়ই ওয়েস্টার খাবারের জন্য বায়না করত।

দ্বিতীয় পর্বে ‘মঙ্গোলিয়ান মার্ক’ লেখা হয়েছে সর্বদ্রষ্টা বক্তার (ওমনিশ্যান্ট ন্যারেটর) ভাষায়। এখানে মূল দৃষ্টিভঙ্গি ইয়েয়ং হাইয়ের ভগ্নিপতির। আর তৃতীয় পর্ব ‘ফ্লেইমিং ট্রিজ’–এর বক্তা ইয়েয়ং হাইয়ের বোন ইন হাই। তিনটি অংশের মাঝখানে সময়ের ব্যবধান দুই বছর করে। মূল চরিত্রের সরাসরি বক্তব্য খুব অল্প পরিমাণ হলেও তার প্রাণী হত্যা নিয়ে পরিবর্তিত মনোভাব অনেকটাই বোঝা যায়। নিজে খাওয়ার জন্য অন্য প্রাণকে ধ্বংস করার ব্যাপারটি সহ্য করতে না পারা ইয়েয়ং একপর্যায়ে স্বামীর ‘শরীরে মাংসের গন্ধ’ পায় বলে তার সঙ্গে যৌন সংসর্গও ত্যাগ করে। স্বামীর বয়ানে জানা যায়, এই প্রত্যাখ্যানের ফলে ইয়েয়ংকে বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার পর্যন্ত হতে হয়।

ইয়েয়ং হাইয়ের নিজের শরীর ও জীবনের ওপর তার অধিকার না থাকার বিষয়টির উল্লেখ করে এ আখ্যানকে তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসেবে দেখেছেন দ্য ইনডিপেনডেন্ট–এর বিশ্লেষক জুলিয়া পাসকাল। দ্য অস্ট্রেলিয়ান বইটিকে অদ্ভুতুড়ে বা ‘আনক্যানি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। গ্যাজেট ভ্যান আনটওয়েরপেন বলেছে, এটি হারুকি মুরাকামির ভক্তদের জন্য উপযোগী এক বই। আবার দ্য আইরিশ টাইমস একে দেখছে নারীদের প্রতি নিষ্ঠুরতার আখ্যানরূপে। আর দ্য গার্ডিয়ান–এর মতে, এই উপন্যাস নানা পীড়াদায়ক প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে।

উপন্যাসে হান কাং এমন এক দুনিয়ার চিত্র তুলে ধরেন, যা দৈনন্দিনতায় ভরা; কিন্তু খানিকটা বীভৎস, অদ্ভুত। পারিবারিক পরিস্থিতি বর্ণনার মধ্য দিয়ে তিনি উপস্থাপন করেন সমাজের সেসব রক্তাক্ত অনুভূতি, সচরাচর যেসব জনসমাজের সামনে আসে না। দ্য ভেজিটারিয়ান–এ বিষয়গুলো যেমন পোক্তভাবে উপস্থিত, তেমনি আছে হিউম্যান অ্যাক্টস–এও। মহান সাহিত্য যা করে, খবরের কাগজে পড়ে ভুলে যাওয়া একেকটি তথ্য বা গল্পের পেছনের বিশাল আখ্যানটিকে মহাকাব্যের মতো বিস্তৃতিতে নিয়ে যায়—হিউম্যান অ্যাক্টসও একই কাজ করেছে। ডং হো নামের কিশোরও হানের ছোটবেলায় পাওয়া সেই স্মরণিকা থেকে উঠে আসা। গোয়াংজুর গণহত্যার সময় নিহত আরও নাম না জানা কিশোর-তরুণেরাও উপন্যাসের চরিত্র হয়ে এসেছে। হান কাংয়ের কলমে বিভিন্ন নামের এসব শহীদ আসলে কাল্পনিক কোনো চরিত্র নয়। গোয়াংজু অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে লেখা হিউম্যান অ্যাক্টস–এর সঙ্গে পাঠকেরা নকশাল বা সম্প্রতি বাংলাদেশে ছাত্র–জনতার যে অভ্যুত্থান ঘটল, তার মিল পেতে পারেন।

খুব বেশি না লিখেও দক্ষিণ কোরিয়ার নোবেলজয়ী এই কথাশিল্পী আখ্যান রচনায় অনন্য আর নিজস্ব শৈলী সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছেন। দ্য কনভারসেশন–এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে হান কাং যে কথা বলেন, সেটি হয়তো তাঁর লেখালেখির মূল মন্ত্র। কাংয়ের কথা হলো, মূলত তাঁর উপন্যাস মানবজীবনের যন্ত্রণা আর বেদনা নিয়ে লেখা। মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিক বর্বর আচরণ, অসহনীয় নির্মমতা তাঁকে খুবই পীড়া দেয়।

এ কারণেই কি হান কাংয়ের লেখার অন্দরমহলে এত চাপা রক্তের ছাপ দেখা যায়, আর একের পর এক তিনি লিখতে থাকেন রক্তাক্ত মানুষের গল্প?

কোরিয়ান চলচ্চিত্রে যাঁদের আগ্রহ, তাঁরা এ ব্যাপারে একমত হবেন যে হত্যা, মৃত্যু, নৃশংসতাকে অন্য এক দৃষ্টিতে দেখার আর দেখানোর প্রবণতা আছে কোরিয়ানদের মধ্যে। সম্প্রতি অস্কার পাওয়া ছবি প্যারাসাইট–এও আমরা দেখেছি চরম দারিদ্র্যের ফলে মানবিক অধঃপতন এবং এর সমান্তরালে ধনকুবের এক পরিবারের বিলাসী জীবনযাপনের প্রতি বিদ্বেষ; ফলাফল হত্যা আর নিষ্ঠুরতা।

কাংয়ের লেখায় যে টুকরা টুকরা রক্তাক্ত জগৎ, যে নিষ্ঠুরতা, তা বৃহদাকারের নয়, অনেকটা ফুটকির মতো; কাব্যিক ভাষার আচ্ছাদনে অজস্র রূপক দিয়ে ঘেরা। তাঁর উপন্যাসে ডুব দিলে অনুভব করা যায় সেই ‘আনক্যানি’ ভরা দুনিয়াকে।

বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা সহ-

তোমার সুস্মি
১২ এপ্রিল,২০২৫
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















জেরাল্ডের এপার্টমেন্টেরও জেরাল্ডের মতই দু’খানা আলাদা সত্তা আছে। তাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোনও বিরোধ নেই। একজন আরেকজনের ব্যাপারে নাক গলায় না এবং একজন আরেকজনকে এতটুকুও জায়গা ছেড়ে দেয় না। সত্তা দুটি এতটাই আলাদা যে সত্যি সত্যিই একজনের সঙ্গে আরেকজনের সাক্ষাৎ হবার কিম্বা মিলেমিশে কাজ করবার সেরকম কোনও অবকাশ তৈরি হয় না। অবশ্য তাদের মালিকানা রয়েছে একজন মানুষের হাতে এবং সেই মানুষটির চারপাশের পরিবেশের মধ্যে একসঙ্গে ও প্রায় একই সময়ে তাদের স্ফুরণ ঘটতে থাকে। জেরাল্ডের প্রকৃত সত্তা কোনটি তা কেউ বলতে পারে না, এবং তিনি নিজেও যে কেন কোনও বিশেষ একটিকে অগ্রাধিকার দেন না, সেই বিষয়টা জানা যায় না। কিন্তু প্রাধান্য দেবার প্রাসঙ্গিকতা এখন শুধু গৌণ নয়, বেশ দেরি হয়ে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর, পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের যুবক জেরাল্ড সন্দেহাতীত ভাবে দ্বৈতসত্তার অধিকারী। তবে তার সঠিক কারণটা কারো কাছেই বোধগম্য নয়। হয়তো বা শারীরিক এবং মানসিকভাবে তিনি খুব দুর্বল ছিলেন শিশু বয়সে। এমনটিও বলা হয় যে তাঁর রক্তে বিচিত্র জাতির মিশ্রণ ঘটেছে। তাঁর মা ছিলেন এক ইহুদি বিদ্বান পণ্ডিত ব্যক্তির কন্যা এবং তাঁর বাবা উত্তর ফ্রান্সের কৃষক পরিবারের সন্তান, যে পরিবারে এক দু’জন ধর্মযাজক ছাড়া বেশির ভাগ মানুষ ছিল ক্ষেতখামারের মালিক। জেরাল্ড তাঁর পূর্বজদের সম্বন্ধে উল্লেখ করতে পছন্দ করতেন, যেমন মনস্তত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহের বিষয়টা তিনি সম্ভবত তাঁর পিতামহের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। তাঁর পিতামহ ছিলেন একজন যাজক। বিশাল বিদ্বান না হলেও তিনি ছিলেন সুবক্তা এবং মানুষের মন ও আত্মাকে পড়ে ফেলবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। অপরপক্ষে মানুষ বিষয়ে জেরাল্ডের বাবার সেরকম আগ্রহ ছিল না। তিনি কাঠখোট্টা, লাজুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। এক কৃষককন্যাকে বিবাহ করে গ্রামের খামারবাড়িতে বসবাস করে নিস্তরঙ্গ জীবন কাটানো ছাড়া বিশেষ কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না তাঁর। কিন্তু খামারের মালিকানা আসলে ছিল জেরাল্ডের বাবার খুড়তুতো দাদার এবং অবশেষে জেরাল্ডের বাবা কৃষককন্যার বদলে প্রফেসর রোজেনদালের জ্ঞানী এবং পরিশীলিত স্বভাবের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। সেই কন্যার ত্বক ছিল সম্পূর্ণ সাদা এবং হাতগুলো ছিল ভীষণ ফ্যাকাসে। জেরাল্ডের বাবা প্যারিস গিয়েছিলেন আইন বিষয়ে পড়াশুনা করবার জন্য, যদিও সে কার্যক্রম আর শেষ করে উঠতে পারেননি। এক বন্ধুর মাধ্যমে প্রফেসর রোজেনদালের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তাঁর। একাকিত্ব, কঠোরতা এবং নিজস্ব ক্ষোভের বাতাবরণ সামলে উঠতে উঠতে কী ভাবে যেন প্রফেসর রোজেনদালের কন্যার প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। প্রথমে যদিও সেই কন্যাকে খুব অদ্ভুত মনে হত তাঁর। ওই কন্যার সৌন্দর্য তাঁর মনে অদ্ভুত ভীতির উর্দ্রেক করতো এবং আসলে তিনি সেই কন্যাকে ঘৃণা করতেই চেয়েছিলেন। মেয়েটি তাঁকে বন্য জন্তুর মত মনে করে, এ কথা বুঝতে পেরে মনে ব্যথা পেয়েছিলেন তিনি। কালেভদ্রে মেয়েটি তাঁর সঙ্গে কথা বলত। যেটুকু বলত, সে কথা ভারি সংযত। যদিও মেয়েটি খুবই জ্ঞানী ছিল, তবুও তাঁর সঙ্গে ছোটখাট সাধারণ বিষয়েই কথাবার্তা হত। মেয়েটি জানত যে সে ছাত্র, পড়াশুনা করে; তবুও ভারি ভারি তত্ত্বের কথা কোনো দিন বলেনি তাঁর সঙ্গে। তিনি অনুভব করেছিলেন যে সেই মেয়েটিও তাঁর প্রেমে পড়েছে। একদিন কাছে ডেকেছিলেন মেয়েটিকে এবং ধর্ষণ করেছিলেন। অবশেষে তাঁদের বিবাহ হয় এবং জেরাল্ডের জন্ম হয়। জন্মের সময় জেরাল্ডের মায়ের অবস্থা মরোমরো হয়েছিল, কারণ শিশু এত বিশাল আকারের ছিল যে সবাই ভেবেছিল বড় হয়ে বাবার মত দৈত্যাকৃতি চেহারা হবে। কিন্তু পাঁচ বছর বয়সে তাঁর ভারি অসুখ করেছিল এবং বাড়বৃদ্ধি কমে গিয়েছিল। ছোটখাট চেহারা নিয়েই বেড়ে ওঠেন তিনি; প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই মায়ের মৃত্যু ঘটে। তাঁর বাবা প্যারিস শহরটার সঙ্গে কখনই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি; ফলে জেরাল্ডকে পড়াশুনার জন্য প্যারিসে রেখে দিয়ে তিনি গ্রামে ফিরে যান তাঁর নিঃসন্তান খুড়তুতো দাদার রেখে যাওয়া খামারবাড়িতে।

সেই থেকে জেরাল্ড নিজের মত থাকেন। তিনি ডাক্তারি পড়েছিলেন; প্যারিসের হাসপাতালে কয়েকবছর শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে করতে শল্যচিকিৎসক হিসেবে বেশ পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং বুঝতেও পারেননি যে কবে যেন তিনি এক বিখ্যাত মানুষ হয়ে উঠেছেন। এই পর্বের শুরুতেই যে দু’খানা সত্তার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, সেই বিষয়টার সঙ্গে জেরাল্ডের এক বিশেষ প্রতিভার গূঢ় সম্পর্ক আছে। যেমন, তাঁর একটা অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণী ক্ষমতা আছে। শল্যচিকিৎসক হিসেবে অবশ্য সেই প্রতিভার সদ্ব্যবহার করবার সুযোগ পান না তিনি। কিন্তু শল্যচিকিৎসক হিসেবে অনেক বেশি মানুষের সঙ্গে পরিচিতি ঘটবার সুযোগ থাকে এবং অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে তাঁর পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে পারেন। জেরাল্ড একেবারেই কৌতূহলী ব্যক্তি নন। যাঁদের পর্যবেক্ষণ করবার জন্য তাঁর আগ্রহ জন্মায়, তাঁদের তিনি একটু আলাদাভাবে খাতির করেন। তাঁদের জীবন বিষয়ে অবশ্য তিনি কিছু জানতে চান না। তাঁদের কার্যকলাপ অথবা মানুষ তাঁদের সম্বন্ধে কী বলে, সেসব নিয়েও তিনি এতটুকুও মাথা ঘামান না। কিন্তু তিনি তাঁদের সঙ্গে দেখা করেন, ধীরস্থির ভাবে তাঁদের দিকে চেয়ে থাকেন, নানা কথাবার্তা বলেন, তাঁদের মুখমণ্ডলে আনন্দ অথবা বিষাদের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করতে থাকেন নিবিষ্টমনে। তাঁদের হাত নাড়া, চলাফেরা, বসে থাকা কিম্বা দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা, কে কী ভাবে সিগারেট ধরাল… এইসব… সব কিছুই যেন মানুষগুলির মনোজগতের দরজা খুলে দেয় জেরাল্ডের কাছে। তিনি দাবি করেন যে অনেককিছুই মানুষ লুকিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু বাইরের চেহারায় মানুষের মনের ছবি ফুটে উঠবেই। মানুষের মনের ছবি খুঁজে বের করবার ইচ্ছেটাই জেরাল্ডের আগ্রহের প্রধান চালিকাশক্তি। তিনি প্রতারিত হতে চান না এই ব্যাপারে। সব সময় সত্যিটা খুঁজে বের করতে মন চায় তাঁর। বিভিন্ন বস্তুর আপেক্ষিকতা তাঁকে দীর্ণ করে। তিনি শিখেছেন যে মানুষকে মূল্য দেওয়া উচিত এবং কেউ কেউ তাঁকে এই শিক্ষা দিয়ে যায় যে তাঁর এই ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল। যে ভাবে উৎকৃষ্ট শিল্পকর্মের নির্দিষ্ট মূল্য থাকে, সেইভাবেই মানুষকেও মূল্য দেওয়া উচিত বলে মনে হয় তাঁর; কিন্তু মাঝেমাঝে তিনি ভুল প্রমাণিত হন। কারণ, সবার সেই মূল্য পাবার যোগ্যতা থাকে না। মূল্য এবং অযোগ্যতার মধ্যে পার্থক্য না করতে পারার অক্ষমতা অবশ্য খুব বেশি বিরক্তিকর ব্যাপার নয়। কিন্তু অপরপক্ষে জেরাল্ড অনুভব করেন যে, বিপরীতে, তার এই ক্ষমতার সঙ্গে কল্পনা বা আত্মবিশ্বাসের কোনো সম্পর্ক নেই; মানুষের যেমন দৃষ্টিশক্তি থাকে, ঠিক তেমনই এটি একটি শক্তি, একটি প্রতিভা এবং অবিশ্বাস্যভাবে তিনি এই ক্ষমতার অধিকারী। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবার জন্য তিনি শব্দ হাতড়ে ফিরতে থাকেন। এই ক্ষমতার গুণগত বৈশিষ্ট্য কথায় প্রকাশ করতে গেলে সেরকম কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম কিম্বা আইন নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে যে, নৈতিকতার মান দ্বারা মানুষকে বিচার করা চলে না এবং শিল্পকীর্তিগুলিও সব সময় সৌন্দর্যের মান দ্বারা বিচার করা সম্ভব হয় না। কারণ নৈতিকতা নির্বিকল্প নয়, এবং সৌন্দর্য মানুষের স্বাদের মত পরিবর্তনশীল। তবে যে সৌন্দর্য চিরকালীন এবং শাশ্বত, তার সঙ্গেই হয়তো বা একমাত্র তুলনা চলে জেরাল্ডের এই বিশেষ ক্ষমতার গুণমানের বিধিগুলির। যদিও বিষয়টা পুরোপুরি শিল্পকলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না, কারণ বিশ্বসংসারের নানা বিচিত্র প্রাণময় এবং জড়বস্তু… সব, সবকিছুর প্রতি জেরাল্ড আকর্ষিত বোধ করেন এবং এই আকর্ষণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর এই বিশেষ ক্ষমতার রহস্য।

আমরা দেখতে পাচ্ছি যে জেরাল্ডকে আর পাঁচটা সাধারণ দ্বৈতসত্তাসম্পন্ন মানুষের শ্রেণিতে রাখা যাবে না। তাঁর ব্যাপারটা এমন নয় যে একটা বহির্জগতের পেশাগত সত্তা এবং আরেকটা ঘরোয়া সত্তা; এমন নয় যে একটা প্রকাশিত এবং আরেকটি গোপনীয়; এমন নয় যে একটা সত্তা দিনের বেলায় প্রকাশ পায় এবং আরেকটি রাতে। তাঁর ক্ষেত্রে এরকম অতিসরলীকরণ একেবারে অর্থহীন। তাঁকে দ্বিখণ্ডিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী বা দ্বৈতসত্তাসম্পন্ন মানুষ বলে সরাসরি দেগে দেওয়া যাবে না। আগেই বলেছি যে তাঁর ক্ষেত্রে একটি সত্তার সঙ্গে আরেকটির কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু তাঁর অন্তরে একটা গোপন নেশা আছে যেটা তাঁকে সত্যসন্ধানের জন্য তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনি খুঁজে বের করতে চান যে এই জগতে ‘সত্য মূল্য’ বলতে ঠিক কী বোঝায়। আমাদের জীবনের দৈনন্দিন ওঠাপড়ায়, প্রতিনিয়ত যন্ত্রণাকাতর মনুষ্যজীবনে কী সেই পরম প্রাপ্তি, কোন বস্তু একেবারে ধ্রুব, যার ঐশ্বরিক কর্তৃত্ব আছে এবং যা একেবারে স্বতন্ত্র… এই সব তিনি খুঁজে ফিরতে থাকেন। আমরা যদি বলি যে জেরাল্ড প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের অন্বেষণে রত, তাহলে অসঙ্গত হবে না। জেরাল্ডের প্রতিদিনের সাধারণ জীবনযাপনে, পেশাগত কাজে যে সত্তা ব্যস্ত থাকে, তাঁর সঙ্গে যে মানুষটি পিয়ানো বাদনরত কিশোর বের্নহার্ডের মুখের দিকে তাকিয়েছিল, তাঁর কোনো মিল ছিল না। জেরাল্ড হঠাৎ যেন এক কোমল হাতের পরশ অনুভব করেছিলেন…

‘আমাদের সম্পদ…’ তিনি বলেছিলেন তাঁর সঙ্গীতশিক্ষক বন্ধুকে। তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন বের্নহার্ডের বাজনা শুনে এবং বলেছিলেন যে এই ছেলে একদিন খুব ভাল পিয়ানোবাদক হবে এবং কোনো কোনো মাপকাঠিতে এই কিশোরের প্রতিভা অসামান্য।

‘এই সম্পদ রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। অতি অবশ্যই এই কিশোরের সত্তা বিশেষ স্বতন্ত্র!’ বের্নহার্ডের হালকা বাদামি মুখমণ্ডলের বিষণ্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করলেন জেরাল্ড। তিনি এখনও জানেন না যে বের্নহার্ডের ঠিক কোন বৈশিষ্ট্য তাঁকে আকর্ষণ করছে। কিন্তু এত অল্পবয়সী একজন মানুষ কী ভাবে এত অনায়াসে বাখের কম্পোজিশন বাজিয়ে দিতে পারে? এই কিশোরের বাহ্যিক প্রকাশ এবং বাজনা সবকিছুই এক ছন্দে গাঁথা; কোথাও এতটুকু বিন্যাসের অভাব নেই। জেরাল্ড বাদ্যযন্ত্রের উপরে আনত কিশোরের ক্ষীণকায় শরীরের দিকে তাকিয়ে ভেবে চলেন… কাঁধ ঈষৎ ঝুঁকে পড়েছে, মুখ অদ্ভুত গাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ, সুরের প্রতি সম্পূর্ণ নিবেদনে ডুবে আছে মন। গাঢ় সোনালী চুলের গুচ্ছ এসে পড়েছে কপালে, ধূসর চোখ বিষাদে ঢাকা, চেয়ে আছে পিয়ানোর চাবিগুলোর দিকে, মাঝে এক দু’ বার বাজনা থেকে মুখ তুলে জেরাল্ডের সঙ্গে চোখাচোখি হল। দুই হাত বড়, চওড়া, সুন্দর, উষ্ণ, বলিষ্ঠ কিশোরের হাত…

জেরাল্ড পরে বের্নহার্ডের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন যে সে কেমন যেন বিব্রত বোধ করছে কথা বলতে। তিনি তাঁর বাজনা এবং প্রতিভা ইত্যাদি নিয়ে প্রশংসা করছিলেন। কিন্তু এই কিশোর অপ্রতিভ ভঙ্গিতে চুপ করে থাকে। জেরাল্ড তাঁর অস্বস্তি কাটাবার চেষ্টা করেন, কিন্তু বিশেষ লাভ হয় না। এক্ষেত্রে জেরাল্ডের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা কিছুটা ধাক্কা খায়। বের্নহার্ডের বাজনা শুনে তাঁর মনে হয়েছিল যে এই কিশোর অত্যন্ত পরিণতমনস্ক এবং সপ্রতিভ। অথচ ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো। অর্থাৎ তাঁর ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আসলে তিনি এই বয়সের ফরাসি ছেলেদের বিষয়েই সাধারণত জানেন, যারা শিক্ষা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সপ্রতিভ এবং বাক্যবাগীশ হিসেবে গড়ে তোলে। এই জায়গাতেও একটা প্রতিবন্ধ কাজ করছে, কারণ বের্নহার্ড এখনও ফরাসি ভাষা খুব ভাল শিখে উঠতে পারেনি। ফলে সে নিজেকে সাবলীলভাবে প্রকাশ করতে পারছে না।

শেষে জেরাল্ড বের্নহার্ডকে জানিয়েছিলেন যে কোনও প্রয়োজনে কিম্বা যদি কোনও বিষয়ে কিছু জানার দরকার হয়, তাহলে যেন সে অতি অবশ্যই জেরাল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রয়োজন ছাড়াও সে যখন ইচ্ছে যেতে পারে জেরাল্ডের কাছে। বের্নহার্ড তাঁকে ধন্যবাদ দেয় এবং তাঁর ঠিকানা ও ফোন নাম্বারের জন্য একটা ভিজিটিং কার্ড চেয়ে নেয়। জেরাল্ড আন্তরিকভাবে বলেন যে আবার তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য তিনি ইচ্ছুক। শীঘ্রই আবার যেন সে দেখা করে। কিন্তু জেরাল্ড সেদিন ভুল ভেবেছিলেন। বের্নহার্ড জেরাল্ডের সঙ্গে দেখা করেছিল ঠিকই। তবে খুব তাড়াতাড়ি সেই সাক্ষাৎ ঘটেনি। বেশ অনেকগুলো সপ্তাহ চলে গিয়েছিল এবং সেই সময়টুকুর মাঝখানে বের্নহার্ডের জীবনে অনেককিছু বদলে গিয়েছিল।



(চলবে)
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in



















চব্বিশ

আজ সমীরণ সকালে বলল,আজ আমরা অট্টহাসতলা যাব।তৈরি হয়ে সকলে বেরিয়ে পড়ল।সমীরন বলে,কলকাতা থেকে ধর্মতলা থেকে নিরোলের সরকারি বাস (SBSTC) পাবেন। তবে বাসে সময়টা একটু বেশিই লাগে। বাস ছাড়ার সময় হল বিকেলে তিনটে। ওই বাস বাসটি নিরোল পৌঁছায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ। নিরোলে নেমেই টোটো রিক্সা করে পৌঁছে যান অট্টহাস সতীপীঠে। আপনি চাইলে মন্দিরে আগে থেকে ফোন করেও আসতে পারেন। তাতে আপনারই সুবিধা। অতিথিতের থাকার জন্য জায়গা আছে। ভক্তদের থাকা, খাওয়া মন্দির থেকেই পরিচালিত হয়।

এছাড়াও কাটোয়ার আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্মস্থান। যেমন, চৈতন্য চরিতামৃতের লেখক কৃষ্ণদাস কবিরাজের বাড়ি ঝামতপুর নামের এক গ্রামে। বাংলায় মহাভারতের রচয়িতা কাশীরাম দাসের বাড়ি কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত সিঙ্গি গ্রামে। ফলে অট্টহাসে এলে আপনি এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্মস্থানেও আসতে পারবেন ঘুরতে। অন্যদিকে কাটোয়া থেকে ১০ কিলোমিটার দূরেই জগদানন্দপুর গ্রাম। সেখানেই রয়েছে রাধাগোবিন্দ জিউয়ের মন্দির। যদি আপনার পুরাতত্ত্ব নিয়ে আগ্রহ থাকে, তাহলে এই মন্দিরের গঠনশৈলি আপনাকে অবাক করবেই।মন্দিরের পূর্বপাশে সাধক ভোলাবাবার মন্দির ৷ পঞ্চমুন্ডির আসন ৷ রটন্তী কালিকা মন্দির ৷এই কালীর কাছে ডাকাতরা পুজো করত ৷ আগে অট্টহাসে পূজার পর শিবাভোগের( শিয়ালকে খাওয়ানো ) ব্যবস্থা ছিল ৷ ১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় শৃগালকূল ধ্বংস হওয়ায় ৷ এখন ওই প্রথা উঠে গেছে ৷ শাক্তদেবী হলেও এখানে বাৎসরিক পুজো হয় বৈষ্ণবীয় উৎসবের সময় দোল বা ফাল্গুনী পূর্ণিমায় ৷ এখানে ধূমধাম সহকারে ওই উৎসবের প্রচলন করেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ বা কাটোয়ার বিখ্যাত দুলাল সাধু ৷

যদিও বীরভূমেও অট্টহাস সতীপীঠ আছে ৷যা লাভপুরের কাছে ৷ সেখানেও গিয়েছি ৷ আগে বলেছি সেই সাধনপীঠ তথা সতীপীঠের কাহিনী ৷

এই সতীপীঠে দেবীর পাথরের প্রতিমা উপর মহিষমর্দ্দিনীর পাথর মূর্তি রেখে নিত্যসেবা করা হয় ৷মহাভোগ যোগে কালীমন্ত্রে দেবী পূজিতা হন ৷এখানে মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী দন্তরা চামুন্ডা ৷ ভূগর্ভের কয়েক হাত নিচে রয়েছে সতীর মূল শিলা বা পাথর ৷হাজারেরও বেশি বছর আগের একটা নথি পাওয়া গেছে একটা স্কেচ তাতে এর প্রমাণ পাওয়া যায় ৷ "অট্টহাসে চ চামুন্ডা তন্ত্রে শ্রী গৌতমেশ্বরী "৷ তাই , অনেকে বলেন এখানে

প্রাচীন বৌদ্ধ দেবীর হিন্দুআয়ন হয়েছে ৷ তাই , মনে হয় হিন্দু ও বৌদ্ধ তান্ত্রিক , বজ্রযানী ও সিদ্ধাচার্যগণ এখানে সাধনা করেছেন ৷

মায়ের কাছেই ছোট মন্দিরে বিল্লেশ থাকলেও মূল

বিল্লেশ মন্দির বিল্লেশ্বর গ্রামে ৷সেখানে শিব লিঙ্গ মাটিতে বসা ৷ কষ্ঠি পাথরের শিববাহন ষাঁড়ের মূর্তি ৷ মহাপীঠ নিরূপম

গ্রন্থে এই পীঠের কথা বলা হয়েছে ৷ এই পীঠে একসময় ভয়ানক রঘু ডাকাত পুজো করে ডাকাতি করতে যেত ৷ সে নরবলি দিত বলে জনশ্রুতি আছে ৷আবার যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত "বাংলার ডাকাত " বইয়ে বলেছেন এখানে বেহারী বাগদী নামে এক ডাকাত পুজো করে নরবলি দিত ৷ ত্রিশ একর জঙ্গলে ঘেরা এই মন্দিরে আজও গা ছমছমে পরিবেশ ৷

মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ঈশাণী নদী। কাছেই রয়েছে শ্মশান। এই এলাকাটি আগে এত বেশি জঙ্গলে ভরা ছিল যে, দিনের বেলায়ও যেতে সাহস পেতেন না অনেকে। তবে এখন খুব সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে মন্দিরটিকে। রাতে ঘুমানোর সময় কানে আসবে শিয়ালের ও প‍্যাঁচার ডাক, সকালে উঠবেন পাখির ডাকে। শান্ত পরিবেশে ভক্তি ভরে পুজো দিতে পারবেন আপনি। কথিত আছে একমনে মাকে ডাকলে সতীমায়ের উপস্থিতি অনুভব করা যায় আজও।

সত্য যুগে দক্ষ যজ্ঞে সতী শিবনিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত‍্যাগ করেন। এর পর মহাদেব বীরভদ্রকে পাঠান দক্ষকে বধ করতে।সতীর দেহ নিয়ে তিনি শুরু করেন তাণ্ডবনৃত্য ।ফলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ বিভিন্ন ভাগে খণ্ডিত করেন। এই অংশ গুলো যেখানে পরেছে সেখানে শক্তিপীঠ স্থাপিত হয়েছে ।এগুলোকে সতীপীঠ বলে । এগুলি তীর্থে পরিণত হয়েছে। এখানে দেবীর অধর / নিচের ঠোঁট, পতিত হয়।

এরপর অনেক বছর কেটে যায়।এই স্থান জঙ্গল হয়ে ওঠে।তখন এ স্থানের নাম ছিল খুলারামপুর বা তুলারামপুর।পরবর্তীতে এই গ্রামের নাম দক্ষিণ ডিহি হয়।এই গ্রামে কিছু কৃষক বাস করত।তারা মাঠে চাষবাদ করত। ঈশানি নদীর ধারে অবস্থিত এ স্থান ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। দিনের বেলাতেও ওখানে কেউ যেত না। একদিন কৃষকরা চাষ করতে গিয়ে এক সাধুবাবাকে জঙ্গলে ধ‍্যানমগ্ন দেখতে পায়।তাড়া কৌতূহলী হয়ে দলবদ্ধভাবে তার কাছে যায় ও তাকে প্রণাম করেন।সাধুবাবা এখানে যজ্ঞ করেন।যজ্ঞ শেষে তিনি যজ্ঞস্থানে একটি ত্রিশূল পুঁতে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান।চলে যাবার আগে বলেন, এটি একটি সতীপীঠ।

এখানে দেবী ফুল্লরা ও ভৈরব বিশ্বেশ ।এখানে দেবীর দন্তুরা চামুণ্ডা মূর্তি ।এখানে দেবীকে অধরেশ্বরী নামে পূজা করা হয়।এখানে আছে এক প্রাচীন শিলামূর্তি।মন্দিরের অষ্টধাতুর মূর্তিটি চুরি হয়ে গেছে।

সারা বছর এখানে ভক্তরা আসে।তবে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস এ পাঁচ মাস এখানে বহু ভক্তের সমাগম হয়।বহু ভক্তের ইচ্ছাপূরণ হয়েছে এখানে পূজা দিয়ে ।দোলের সময় এখানে বিশাল মেলা বসে। এখানে থাকার জন্য অতিথি নিবাস আছে।মন্দির থেকে ভক্তদের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in










হৃদিবরেষু সুস্মি,

গত পরশু এসেছি কিন্তু পাহাড় থেকে ফিরতে মন চায় না, ব্যস্ততম শহরের ভিড়ে দম বন্ধ হয়ে আসে আর তখন বারবার মনে পড়ে মেঘ-পাহাড়ের মিতালি। পাহাড় বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে ঝরনা। পাহাড়গুলো যেন এক জায়গায় এসে হেলে পড়েছে আকাশে। চারদিকে শুধু সবুজ। সকালে ঘুম ভাঙলেই পাখির ডাক। পাহাড়ের গায়ে কান পাতলে শোনা যায় চার্চের ঘণ্টার ধ্বনি। পাইন ও কফি গাছের সমারোহে আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে নদী ও জলপ্রপাতে।

কেমন হয় একজন পুরুষের নারীবিহীন জীবন? অনেকেই তো ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলেন। তারপর চাইলেই কি তাকে ভুলে থাকা সম্ভব হয়?একজন একাকী ছেলে, নিজের জীবন নিয়ে ডুবে থাকে, সে কি পারে না প্রেমে পড়তে? অথবা নারীদের আজীবন ঘৃণা করে চলা পুরুষটি যদি হুট করে কোনো নারীর প্রেমে পড়ে যায়? আমাদের গেছে যে দিন সেগুলো নিয়ে ভাবতে বসলে জামাল উদ্দিন রুমির কথা খুব মনে পড়ে- যা কিছু হারিয়েছো তার জন্য দুঃখ করো না। তুমি তা আবার ফিরে পাবে, আরেকভাবে, আরেক রূপে। এইবার পাহাড়ে গিয়ে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে পরিচয় হলো, এক সন্ধ্যায় বন্ধন, মায়া নিয়ে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, অতীতকে প্রাধান্য দিও না, ভবিষ্যত নিয়ে দিবাস্বপ্নও দেখবে না। তার চেয়ে বরং বর্তমান মুহূর্ত নিয়ে ভাবো। আমি জানতাম না গৌতম বুদ্ধ এই কথাটি বলেছিলেন তাই আমি যখন তার ভাবনা জগৎ নিয়ে প্রশংসা করছিলাম আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি জানান এই বানী বুদ্ধদেবের। পরক্ষণেই তিনি জানতে চাইলেন আমি হারুকি মুরাকামির লেখা পড়েছি কিনা? একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুর মুখে ধর্মকথা বাদ দিয়ে সাহিত্যের কথা শুনে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম তাই হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বললাম না। কিন্তু আমি জানি হারুকি মুরাকামি এই শতকের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। যদিও জাপানি এই লেখকের বিরুদ্ধে খোদ জাপানে একটি অভিযোগ বারবার উঠে এসেছে যে, তিনি জাপানি ভাষায় মার্কিনি উপন্যাস লেখেন। যেখানে জাপানি সংস্কৃতিকে ছাপিয়ে ভিনদেশি পাঠকের মানসিক ও সামাজিক অবস্থার বয়ান বেশি থাকে। আধুনিক জাপান যে ধরনের সংযত, পরিশ্রমী, সুশৃংখল, কর্মনিষ্ঠ জীবনধারার জন্য বিখ্যাত মুরাকামির গল্প-উপন্যাসে তাদের খুব একটা দেখা মেলে না। তবে মুরাকামির কাহিনিতে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের পণ্য নির্ভর অতি আধুনিক সমাজের দেখা মেলে। অথচ এই আধুনিক, অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ও হাতের নাগালে স্বাচ্ছন্দ্যের সব রকম উপকরণ থাকা মানুষগুলো কোথায় এসে যেন থমকে যায়। এক আশ্চর্য একাকীত্ব, কখনো একঘেয়েমি বা তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাদেরকে গ্রাস করে প্রতিনিয়ত। তাদের হাতের নাগালে সুখে থাকার সব উপকরণ থাকলেও কোথাও না কোথাও জীবনের ছন্দ হারিয়ে ফেলে তারা। বিষন্নতা, নিঃসঙ্গতা, অপূর্ণতা বিরাজ করে তাদের মানস জগতে।

বৌদ্ধ ভিক্ষু আমার চোখের দিকে অপলক তাকিয়ে থেকে কি বুঝলেন জানিনা তবে তার ঠোঁটের কোণে যে হাসি ফুটে উঠেছিল তা দেখে আমার মনে হলো সে হাসিতে আমার জন্য বিদ্রুপ আঁকা কিংবা তিনি মনে মনে আমাকে সস্তার পাঠক ভেবে হাসিতে বলতে চাইছিলেন তোমার পাঠের পরিধি বড় কম! কিছু কিছু সময় মানুষ বোধ করি হেরেও জিতে যায়। যেমন ঠিক সেই সময়টায় আমি! তিনি চোখ বন্ধ রেখে বৌদ্ধকে স্মরণ করলেন হয়ত বা আমাকে কী কী বলবেন সেটা মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে চোখ খুলে বলতে শুরু করলেন সত্যি বলতে হারুকি মুরাকামির লেখাকে এর আগে আমি কখনো এইভাবে বৌদ্ধ দর্শনের নিরিখে পড়িনি। সত্যি বলতে বৌদ্ধ ভিক্ষুর কথা শোনার পরে নিজেকে বড় নির্বোধ মনে হচ্ছিল কিন্তু আমার চোখ খুলে দেবার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুল করিনি।

ছোটগল্প নাকি আজকের দিনে এক ‘মৃতপ্রায় শিল্প’ বা ‘ডায়িং আর্ট’, কারণ পরিসংখ্যান প্রমাণ দিচ্ছে যে আধুনিককালের বিশিষ্ট সাহিত্যিকেরা আর ছোটগল্প লিখছেন না। গত কুড়ি বছরে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক লাভক্ষতির হিসেবেই জাপানের হারুকি মুরাকামি’র ছোটগল্প বিশিষ্ট আসন লাভ করেছে। জাপানি-ভাষায় রচিত লক্ষাধিক কপি বিক্রি হওয়া তাঁর উপন্যাসগুলো ইংরেজিসহ বিভিন্ন ইয়োরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়ে আজ বেস্টসেলার। সেরকমই মুরাকামি’র ছোটগল্পের অনুবাদও তাঁর উপন্যাসের মতো একইরকম আদরণীয়। মুরাকামি’র ছোটগল্প-সংকলনগুলোর অধিকাংশই আগের শতকের শেষবেলায় প্রকাশিত, কিন্তু ইংরেজি-অনুবাদে বইগুলোর বিশ্বের বাজারে পদার্পণ বেশিদিন আগেকার নয়। জাপানি-ভাষার হালের সবচাইতে জনপ্রিয় এই সাহিত্যিকের ছোটগল্পে কী এমন বিষয়ধর্মীতা রয়ে যাচ্ছে, বিশ্বের পাঠকের কাছে নিরবচ্ছিন্ন আবেদন রেখে চলেছে গত কয়েক দশক ধরে? ব্যাপারটিকে আধুনিক এক-সংস্কৃতির বিশ্ব বা বিশ্বায়নের নিরিখে ভাবতে চাইছেন অনেকেই। মুরাকামি’র বিশ্বে পূর্ব আর পশ্চিমের সংস্কৃতির পাশাপাশি বয়ে চলা রয়েছে, সংঘাত এবং পরাভব রয়েছে, কিন্তু দুই সংস্কৃতির ‘এক’ হয়ে যাওয়ার কথা কোত্থাও বলা নেই।

বৌদ্ধ ভিক্ষু ‘হাতিটা উধাও’ গল্পটি নিয়ে কথা শুরু করে বলেছিলেন এই গল্পটি পড়লে দেখবেন, বৃদ্ধ হাতি মাহুতসহ একদিন উধাও হয়ে যায়। যে মাহুতের সাথে হাতিটার এক ধরনের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। দীর্ঘ এই সম্পর্কের ঠিক কোনো ব্যাখ্যা হয় না। তবে হাতিটা বৃদ্ধ, সে যেকোনো সময় মরে যেতে পারে। সে একটা বিশাল গরাদে বন্দি অবস্থায় থাকে, এ অবস্থায় সে কিভাবে মাহুত সমেত উধাও হয়ে যেতে পারে! এই উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় সবাই তার তত্ত্বাবধায়নকারী সিটি কর্পোরেশনের অবহেলাকে দায়ী করতে থাকে। কিন্তু এই গল্পের কথক জানান, হাতিটা তিনি মাহুত সমেত আকার পরিবর্তন করে উধাও হয়ে যেতে দেখেছেন। অর্থাৎ হাতিটা তার আকার পরিবর্তন করে ছোট হয়ে গরাদের বাইরে বের হয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। আবার একই সাথে বিষয়টি তার কাছে অতো পরিস্কারও নয়, যেন ঝাপসা এক ঝলক মাত্র। এই ঘটনা কথকের ভেতরে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। তিনি কিছু একটা করতে চান বলে ঠিক করেন আবার পরক্ষণেই ভাবেন, ব্যাপারটা করা আর না করার মধ্যে পার্থক্যটা কি! এক ধরনের দোলাচলে ভোগা লোকটা ভাবেন, চারপাশের সবকিছুর সঠিক ভারসাম্য যেন নেই। বৌদ্ধ দর্শনের আলোকে যদি চিন্তা করেন ঠিক এই পরিস্থিতিতে সেই ব্যক্তি তখন ধর্মহীন৷ ‘ধর্মহীন’ শব্দটির বৈদিক ও বৌদ্ধ অর্থে, বা ব্যুৎপত্তিগতভাবে ভাবলেও, সেই ব্যক্তি এমনই এক সত্তা যার কোনও ‘আধার’ বা ‘ধারক’ নেই। এই ‘মুক্ত’ সত্তাটির জন্য কোনও চেতনার রূপান্তর বা চেতনা হতে চেতনায় পৌঁছে যাওয়া, বা ‘চেতনান্তর’ ঘটবে না। অর্থাৎ বাইরের পৃথিবী আর তার অন্তর্জগতের মধ্যে কোনোরকম সাম্যতা লক্ষিত নাও হতে পারে। তাই তার দৃষ্টিতে প্রকৃতির স্বাভাবিক ঘটনাগুলো অস্বাভাবিক ঠেকতে পারে, কার্য-কারণের সাধারণ হিসেবও গুলিয়ে যেতে পারে। সে যেন আজকের পৃথিবীর বহুল পরিচিত সেই মানুষ, যার সব থাকা সত্ত্বেও সে অন্তর থেকে অসুখী এবং আত্মপ্রত্যয়ের অভাবে দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা কেউ একজন। এমন মানুষের পরিচয় ইতিপূর্বে পশ্চিমের সাহিত্যে আমরা হয়ত অনেকবারই পেয়েছি। কিন্তু এই নিরিক্ষা সেসব ক্ষেত্রে একান্ত অনুপস্থিত। মুরাকামি’র নিরিক্ষা একান্তভাবেই পূর্বদেশীয়, যা পশ্চিমের অধিকাংশ আলোচকদের চোখে ‘এ সাটল টাচ অফ জেন! ইস্টার্ন ম্যানিফেসটেশন অফ দ্য ওয়ার্ল্ড আফটার গ্লোবালাইজেশন!’ ভিন্ন আর কিছু নয়। বৌদ্ধ ভিক্ষু গল্প ধরে ধরে বৌদ্ধ দর্শনের সাথে প্রতিটি গল্পকে মিলিয়ে দিচ্ছিলেন আমার ভাবনায় তখন রামায়ণের একটা কাহিনি ভেসে ওঠে। যেখানে রামচন্দ্রের প্রেমে পড়ে সূর্পণখা নামের এক রাক্ষস, এবং রাম তার কুৎসিত রূপ দেখে তার নাক কেটে দেয় ও প্রেম প্রত্যাখ্যান করে। হারুকি মুরাকামি রামায়ণ পড়েছেন কিনা জানিনা তবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় মুরাকামি জাপানের উন্নত সাহিত্য ধারণায় নিজেকে আটকে না রেখে বিচরণ করছেন বিশ্বজনীনতায়, আধুনিকতায়। তাই হয়ত ভাবনায় বা চেতনা জগতে রাম ও সূর্পণখা এসে মিলে মিশে যায় ‘একটি ছোট্ট সবুজ রাক্ষস’গল্পে, যেখানে বাগানের মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসা ক্ষুদে এক সবুজ রাক্ষস প্রেম নিবেদন করে এক নারীকে। যে নারী তার স্বামী কাজে বাড়ির বাইরে বের হয়ে যাওয়ার পর সারাদিন নিঃসঙ্গ সময় কাটান। ওই কুৎসিত দর্শন রাক্ষস নিশ্চয়ই তার কল্পনা নয়! আবার অখণ্ড অবসর কাটানোর উপাদানও হতে পারে না। তবু লেখক কেন প্রেমপ্রার্থী হিসেবে এমন এক কুৎসিত, ভয়ংকর দর্শন রাক্ষসকেই নির্মাণ করলেন! যার প্রেম তো অকৃত্রিম। কিন্তু তার কদাকার চেহারা ওই নারীর কাছে একই সাথে ভয়ঙ্কর ও বিরক্তি উদ্রেককারী। রাক্ষস দীর্ঘদিন ধরে মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে টানেলের মত তৈরি করে তার ভেতর থেকে ক্রোলিং করে এসে যেভাবেই প্রেম নিবেদন করুক না কেন, নারীর তাতে সম্মতি দেয়ার কোনো কারণ নেই! সে মনে মনে রাক্ষসটাকে যতরকম ভয়ংকর ও বীভৎস নির্যাতন করা যায় তা ভাবতে থাকে। নারীর এই ভাবনার প্রত্যক্ষ প্রভাব রাক্ষসটার ওপরে পড়তে থাকে। নির্যাতিত রাক্ষস ক্রমাগত যন্ত্রণায় কাতর হয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে। সে যতই বলে, আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমাকে এভাবে নির্যাতন করার কথা ভেবো না। নারী তত তাকে আরো ভয়ংকর নির্যাতনের কথা ভাবে। এবং বলে, ‘এবার দেখো খুদে রাক্ষস তুমি জানো না, মেয়ে মানুষ কি জিনিস! তোমাকে যে কি কি করার কথা আমি ভাবতে পারি তার শেষ নেই।’ আপাতদৃষ্টিতে কাহিনীটি অদ্ভুত মনে হলেও! এর গভীরে রয়েছে ব্যক্তির হতাশা, বিষন্নতা বা অবিশ্বাস।

মুরাকামির গল্প উপন্যাসের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে সংগীত। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ধ্রুপদি থেকে পপ, জ্যাজ থেকে র‌্যাপ, বারোক সংগীত থেকে রবিশঙ্কর, মোৎজার্ট থেকে বেটোফেন, আবার মাইলস ডেভিস, জোহান স্ত্রাউস বা হালকা চালের হুলিও ইগ্লেসিয়াশ। এছাড়াও ব্রুস স্প্রিংস্টিন, জেফবেক, ডোরস সহ অসংখ্য ঘরানার দেখা মেলে। মুরাকামির লেখায় পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য সব দেশের শিল্প- সংস্কৃতি বা সাহিত্যের উল্লেখ পাওয়া যায়। মুরাকামি আদতে তাঁর কাহিনীজুড়ে চেতনাতে বড়ো ইতিহাসকে নতুন করে বিশ্লেষণ করতে এগিয়ে আসছে ছোট ইতিহাসের নানান ঘটনা, আবার বড়ো ইতিহাস সরাসরি কিভাবে ছোট ইতিহাসের নির্মাণে অংশ নিচ্ছে, কিংবা একটি বিচ্ছিন্ন সত্তা তার চিন্তার মধ্যে কীভাবে বিশ্বজগতকে ধারণ করে রেখে দিতে পারে, বা তাকেও বিপরীত অভিমুখে দেখতে চাইলে দেখা যাবে যে, প্রতিনিয়ত তার স্মৃতির ভেতর নিত্যনতুন অতি ক্ষুদ্র থেকে অতি বৃহৎ সব সত্তার জন্ম এবং একইসঙ্গে মৃত্যুও ঘটছে। একটি মানুষ আসলে অতি-বৃহৎ একটি মানুষ, যে কিনা একসঙ্গে মানব-ইতিহাসের অনেকটা ধারণ করে রেখেছে তার সত্তার ভেতরে। তার প্রকাশ কখনো সরাসরি সত্তার প্রকাশে, কখনো বা বহিরঙ্গে সাদৃশ্যহীন এক পৃথিবী, জীবনযাপন, কিংবা বিসদৃশতায়। কদর্য, রূপহীন, বা কুরূপ নয়। আকারহীন বা সম্পূর্ণ নিরাকারও নয়। একটি জীবন, বা একটি মানুষ যেন বিসদৃশ। ফ্রানৎস কাফকা উত্তরাধুনিক সাহিত্যকালের যত লেখককে কমবেশি প্রভাবিত করতে পেরেছেন, তাদের মধ্যে হারুকি মুরাকামি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কাফকা’র চরিত্রদের মতোই অসংখ্য বিসদৃশ চরিত্রের আনাগোনা তাঁর উপন্যাস আর ছোটগল্প জুড়ে। ‘একটি জানলা’ গল্পের সেই প্রোটাগনিস্ট, কোনও এক সংস্থার তরফে যে চিঠি লিখে বিষাদগ্রস্ত বা প্রেমে আঘাতপ্রাপ্ত একলা মহিলাদের কাউনসেলিং করত, বা ‘অঘটন পথচারী’ গল্পের সেই নিঃসঙ্গ পিয়ানো টিউন-করা ভদ্রলোক, কিংবা ‘চীনে যাওয়ার স্লো বোট’ গল্পের সেই নারী, যে অবিকল কাফকা’র এক নারী-চরিত্রের মতোই চিরকালের নীরব। নিঃসঙ্গ মানুষ নয় তারা কেউই, কিন্তু প্রত্যেকে পৃথিবীর সামনে একটু যেন বিসদৃশ। মুরাকামি আমাদেরকে দেখিয়ে চলেছেন এই দৃশ্যমান এবং চোখে সয়ে যাওয়া জগতটার বাইরেও একটি জগত রয়েছে, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে সময়ের ছোট্ট উপাংশ অচেনা এক বিশ্বের ছোঁয়া দিয়ে চলেছে। একটি ‘লেডার-হাওজেন’ বা ইয়োরোপের মহিলাদের জন্য নির্মিত একরকম লেদারে প্রস্তুত গরম মোজা, যেটি দেহের মাপে মিলে যাওয়া মাত্র এক নারী জীবনের একটি বিশেষ সিদ্ধান্ত নিতে সাহস করে ফেলে, অথচ এতকাল সেই সাহসটুকু তার কাছাকাছি এসেও কীভাবে যেন অধরা রয়ে যাচ্ছিল। কিংবা অত্যন্ত পছন্দের এক পুরুষকে খুঁজে পেয়ে এক নারী জানতে পারে যে সে আসলে ‘গে’, কিন্তু কিছুতেই তাকে পরিত্যাগ করার মতো জোর খুঁজে পায় না। কিংবা, ‘এপ্রিলের এক সুন্দর সকালে ১০০ ভাগ মনের মতো মেয়েটিকে দেখে’ একটি ছেলে বলে ওঠে, ‘আমি যে সারা জীবন তোমাকেই খুঁজছি। তোমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু তুমিই আমার ১০০ ভাগ মনের মতো মেয়ে।’

মুরাকামি কখনই তার ছোট গল্পের সোজাসাপ্টা সমাপ্তি করেননি। সবসময় পাঠকদের সমাপ্তি ভেবে নেবার সুযোগ করে দেন। যেন গল্পটি তার, কিন্তু পাঠক গল্পটি তার নিজের মতো করে গ্রহণ করবে। ছোট গল্প নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ঐ কথার মতই “শেষ হয়েও হইলো না শেষ।” মুরাকামির গল্পে প্রতিটি বিষয়েরই যেন অস্তিত্ব আছে। যাকে ঠিক কল্পনা বলেও ধরে নেয়া যায় না, আবার যে কল্পনা হয়ে দাঁড়ায় অতি বাস্তবের প্রতীক। তিনি তাঁর গল্পে বসবাসকারী চরিত্রদের সুপ্ত বাসনা বা আকাঙ্ক্ষার একটা অদ্ভুত রূপ দেন। তাই মুরাকামি’কে নিশ্চিত করে কোনও নির্দিষ্ট ঘরানা বা গোলার্ধের লেখক বলে আখ্যায়িত করে ফেলাটা অন্যায়। মানুষে জীবনের গভীরতা উঠে আসে মুরাকামির লেখায়। বিষণ্নতা যে গভীর, সে কথাই নানাভাবে বলেন তিনি। ‘ঘুম’ গল্পটাতে আমরা দেখি টানা ১৭ দিন-রাত না ঘুমানো একজন ইনসোমনিয়ার রোগী ঘুম না হওয়াকে এক সময়ে ভাবছেন, ঘুম না হলে হবে না, তবে এই নিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে না ভুগে বরং এটা ভাবতে হবে যে সে তার জীবনটাকে প্রসারিত করছে। অর্থাৎ যে সময়টায় সে ঘুমাতো সেই সময়টা এখন তার একান্ত নিজস্ব একটা সময়। যে সময়টাতে কেউ তাকে বিরক্ত করতে পারবে না, যদিও এভাবে টানা নিদ্রাহীনতা তাকে বাঁচাতে পারেনি, যা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ঘুম গল্পটার মতো তাঁর এমন অনেক গল্পে মানুষের দৈনন্দিন জীবন যাপনকে সাধারণ বা একঘেয়ে মনে হতে পারে,তবুও তার ভেতরেও থেকে যায় যন্ত্রণাময়, বিপজ্জনক বা কখনো মায়াবী এক কাহিনি। ‘কিনো’ গল্পটি, কিনো নামের এক ছেলেকে নিয়ে। যে একটি বার চালায়, শহর থেকে দূরে খুব নিরিবিলি এক এলাকায়। ফাঁকা জায়গা, নিশ্চুপ পরিবেশের ভেতরই কেমন একটা বিষণ্নতা ছড়িয়ে পড়ে। এর চেয়েও বিশাল বিষণ্নতা কিনোর ভেতরেই বসবাস করে। যদিও এ ব্যাপারে সে উদাসীন, তার স্ত্রী এবং সংসার হারানোর কষ্ট সে অনুভব করে না। কিন্তু তার বিষণ্নতা লেখক বারবার পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন, এমনকি সে যে তার অজান্তেই একাকিত্ব থেকে মুক্তি চাইতে শুরু করে, তা-ও পাঠকের সামনে মেলে ধরেন লেখক। কী অদ্ভুত এক খেলা শুরু হয়, গল্পের মূল চরিত্রের সাথে পাঠকের যেন সরাসরি দেখা হয়ে যায়, লেখক আড়াল থেকে বিষণ্নতাগুলো ফুটিয়ে তোলেন। এর চেয়েও চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, পাঠকও একাকিত্ব অনুভব করতে শুরু করে!

হারুকি মুরাকামির গল্পে যৌনতার উপস্থিতি লক্ষণীয়। যৌনতা, গল্পে একটি আবশ্যিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে আসে। কিন্তু সেগুলো আরোপিত মনে হয় না; বরং চরিত্রগুলোর সংকট প্রকাশের একটি ভাষা হয়ে ওঠে। মুরাকামি আসলে সমস্ত জাঁকজমকপূর্ণ জীবনকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় এবং সবার সামনে নশ্বর পৃথিবীর নগ্নতাকে প্রকাশ করে দেয়। আমরা মানুষকে চিনতে পারি বলি বটে, কিন্তু আদতে চিনতে পারি না। প্রেম কি কেবল একটি স্বপ্ন যা আমরা আমাদের একাকী অস্তিত্বের বাস্তবতা এড়িয়ে যাবার জন্য দেখি? মানুষের মানসিক এমন সব আলোচনা, যা মানুষ আসলে বলতে চায় না, কিন্তু পুষে রাখে। কেমন হয় একজন মানুষের নিঃসঙ্গ জীবন? মানুষের বিষণ্নতা কেমন করে তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, যখন কেউ তার নিজের ভালবাসার নারীকে হারিয়ে ফেলে? এসবের মনস্তাত্ত্বিক দিক আর সে সময়ের বিষণ্ণতা নিয়ে মুরাকামি ‘দম দেয়া পাখি আর মঙ্গলবারের মেয়েরা’ গল্পটা পড়তে পড়তে মনে হয় কুয়াশায় আচ্ছন্ন এক পরিবেশে যেন কেউ পেঁজা তুলার মত হাওয়ায় ভাসছে। সন্দেহ, অবিশ্বাস পরস্পর শ্রদ্ধাহীনতা তাঁর গল্পে এই প্রতিটি বিষয়েরই যেন বাস্তব অস্তিত্ব আছে। যা দেখা যায় না ঠিকই, আবার নিছক কল্পনা বলেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। কখনো কখনো কল্পনা হয়ে দাঁড়ায় অজানা অতি বাস্তবের প্রতীক। ‘ক্যাঙ্গারু বার্তা’ গল্পটাতে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের একজন প্রোডাক্ট ম্যানেজার তার কাছে পাঠানো ক্রেতার একটি অভিযোগপত্র পেয়ে হঠাৎই ওই অজানা অচেনা নারীর প্রতি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এখানে প্রেম ঠিক ওভাবে নেই। একটা নির্দোষ, সাদামাটা, বা একটু ভিন্নধর্মী অভিযোগপত্র পেয়ে কেউ কারো প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করতে পারে এমন অদ্ভুত কাহিনি মুরাকামির পক্ষেই লেখা সম্ভব! যেখানে কাহিনি ছাপিয়েও এর ভেতরে রয়েছে ব্যক্তির বিষণ্নতা। বান্ধবী থাকা সত্বেও তার মানসিক নিঃসঙ্গতা। অর্থাৎ সবকিছু হাতের নাগালে থাকতেও এক অদ্ভুত শূন্যতায় আচ্ছন্ন তাদের জগৎ। এই শূন্যতার প্রতীকী প্রতিফলন প্রকাশ পায় প্রায় তাঁর প্রতিটি লেখায়। এই অশান্তির অর্থ কি? উপশম কিসে? সেই খোঁজ কি রয়েছে মুরাকামির সব লেখায়? ব্যক্তি তার একাকিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে একদম একা। এক ধরনের বিমর্ষ একাকীত্ব নয়, আলাদা নানারকম একাকীত্ব আছে। যা খুবই যন্ত্রণার। স্নায়ু ছিড়ে যাওয়ার মতো। একইভাবে ‘মানুষ খেকো বেড়াল’ গল্পে আমরা দেখতে পাই, মানুষ তার সারাজীবন ধরে একজন আদর্শসঙ্গীর অপেক্ষায় থাকে। আর যে কোন সময় সেই সঙ্গীর দেখা পেতে পারে সে। হয়ত বিয়ের কয়েক বছর পরেও মিলতে পারে এমন কোন সঙ্গীর দেখা। দাম্পত্য সম্পর্ক হয়তো মসৃণভাবে চলছে, যেখানে অভিযোগ করার মত তেমন কিছু নেই। শ্রদ্ধা, ভালবাসা সব থাকার পরও হয়ত এমন কারো সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, যাকে দেখলে মনে হয় এর কাছে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মেলে ধরা যায়। মুরাকামি এই ধারণাটাকে ঠিক ভালোবাসার লেবেল দিতে চাননি। এ যেন পরিপূর্ণ সহমর্মিতা। তিনি বিবাহ বহির্ভূত এই সম্পর্কটাকে এত স্বাভাবিকভাবে উপস্থাপন করেছেন, এতো সহজতায় যে তাদের জৈবিক সম্পর্কটা যেন ঠিক যৌনতার জন্য নয়, ভালোবাসার এক শান্ত সমহিত প্রসন্ন টান। মুরাকামি’র উপাখ্যানে বাস্তব জগতে যে ‘বিসদৃশতা’ লক্ষ্য করা যায়, পশ্চিমের আলোচকেরা সেটিকে কাফকা’র কাহিনিতে ঘুরেফিরে বেড়ানো বিচিত্র সব মানব-চরিত্র বা তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ততোধিক বিচিত্র ঘটনাবলির সঙ্গে তুলনা করলেও, এই বিসদৃশতা-কে একান্তভাবে পশ্চিমের উত্তরাধিকার-ভাবনা বলা চলে না। ‘খামার-দহন’ গল্পটাতে এক যুবক জানায়, দুমাস পর পর এক একটা খামার পোড়ানো তার শখ। এখানে সে কোন নৈতিকতার ধার ধারে না। নৈতিকতা তার কাছে ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্বের ভারসাম্য। একই সাথে ভিন্ন ভিন্ন অস্তিত্ব। যেন একই সাথে টোকিওতেও আছে আবার টিউনেশিয়াতেও। ‘চীনে যাওয়ার স্লো বোট’ গল্পে নিজের দেশ জাপান’কে লিখতে বসে আমেরিকা, এবং আমেরিকা’র এক বিপরীত-সংস্কৃতি হিসেবে চায়না’কে নতুন করে মেলে ধরতে চেয়েছেন পাঠকের সামনে। এক নিঃসঙ্গ চাইনিজ ভদ্রলোক, যিনি টেলিফোন ডাইরেক্টরি ঘেঁটে তোকিয়ো শহরে বসবাসকারি চাইনিজ’দের ফোন নম্বর বের করেন, এবং তাদের বাড়ি গিয়ে ‘চাইনিজ এনসাইক্লোপেডিয়া’ বিক্রি করেন। এটিই তার পেশা। তার সঙ্গে একসময়ে যখন কাহিনির প্রোটাগনিস্টের দেখা হয়, তার মনে পড়ে যায়, ভদ্রলোক আসলে ছিলেন তার উচ্চতর ক্লাশের সহপাঠী। আজ তিনি শহরের চাইনিজ’দের বাড়িতে ঘুরে এনসাইক্লোপেডিয়া বিক্রি করেন। মুরাকামি একথাটি একবারও লেখেননি কোথাও, কিন্তু পাঠক নিজের থেকে উপলব্ধি করবেন, স্বদেশ ও সংস্কৃতির প্রতি সমর্পিতপ্রাণ যে ‘চাইনিজ’ ছেলেটি এককালে তার সহপাঠী ছিল, সে আজও একইরকম ‘চাইনিজ’ রয়ে গিয়েছে। কিন্তু কাহিনির প্রোটাগনিস্ট অর্থাৎ জাপানি ছেলেটি কীভাবে যেন নিঃশব্দে ‘আমেরিকান’ হয়ে গিয়েছে। এক অভূতপূর্ব প্যাসিভ ন্যারেটিভ হচ্ছে সুদীর্ঘ এই উপাখ্যানের প্রাণস্পন্দন, যা চরম উপভোগ্য ও স্মরণীয় হয়ে উঠেছে।

হারুকি মুরাকামি সামান্য ছোটগল্পকেও বৃহৎ পরিসরে লিখে থাকেন। আর কাফকা অন দ্য শো’র পরিসরই বৃহৎ, যা মুরাকামির লেখনীতে হয়ে উঠেছে অকল্পনীয় এক সৃষ্টি। জটিলভাবে গল্প না বললেও গল্পের বিষয়বস্তু জটিল হবার কারণে এই বই বিশ্লেষণ করা অনেকের কাছেই ভয়ঙ্কর একটি ব্যাপার। একাকীত্ব, বিষণ্ণতা, নীরবতা, ভালোবাসা, মানুষের বাস্তবিক জীবনের গল্পের কথা মুরাকামির লেখায় বার বার ফুটে উঠেছে। এসব বিষয়কে পাশে রেখে মুরাকামি বাস্তব ও কল্পনাকে মিশিয়ে ফেলতে ভালোবাসেন। তিনি এমন এক ঘরানা নিয়ে লেখালিখি করেন যে ঘরানার লেখক বর্তমানে হাতে গোনা। মানুষের জীবনের গল্প বা একটি মানুষের বেঁচে থাকা জীবনকে তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন প্রত্যেকটা গল্পে তা মুগ্ধতাকেও ছাড়িয়ে যায়। হিয়ার দ্য উইন্ডো বইতে মুরাকামি একটি কথা বলেছিলেন, “যখনই আমি সমুদ্রের দিকে তাকাই, সবসময় তখন আমার কারও সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যখন আমি কারও সাথে কথা বলি, তখন আমার ইচ্ছা করে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকতে। আমি এরকমই অদ্ভুত একজন মানুষ।” বাস্তব ও পরাবাস্তব নিয়ে প্যাঁচ লাগানো নিয়মতান্ত্রিক লেখকের জীবন কি আসলেই এমন অদ্ভুত?

নিরন্তর ভাল থেকো। তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আশা করি হারুকি মুরাকামির লেখায় পেয়ে যাবে কিংবা আমারও…

ভালবাসা সহ-

বাসু
১২ মার্চ,২০২৫
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





















হঠাৎ মনি খিলখিল করে হেসে ওঠে… ‘আমি ভেবেছিলাম যে তুমি ভুলে গিয়েছ!’

মনি বের্শেনের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কপালে, গালে, নাকের উপরে চুমু দিতে থাকে। ভেজা ভেজা শিশুর ঠোঁটে লেগে থাকা দুধের গন্ধ আর প্রাতরাশের ছোট ছোট গোল রুটির গন্ধ পায় বের্শেন।

বের্নহার্ডের বয়স মোটে সতের এবং এই প্রথমবার সে প্যারিসে এসেছে। সে সাধারণত একটা বাদামি রঙের স্যুট আর সাদা শার্ট পরে। যে মহিলার বাড়িতে প্রথমে সে থাকতো, তিনি বলেছিলেন যে সে যেন রঙিন শার্ট পরে, নাহলে তাকে প্রতিদিন জামা বদলাতে হবে, আর সেটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। বের্শেন লজ্জিত হয়ে লক্ষ্য করল যে তার শার্টের আস্তিন এর মধ্যেই বেশ ময়লা হয়ে গেছে। তার পর থেকে অবশ্য সে তার নীল স্পোর্টস শার্টটাই পরা শুরু করেছিল। এমনিতে মহিলা ভালই। তাঁর যা বয়স, তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানাদি থাকবার কথা। কিন্তু সেরকম কেউ আছে বলে মনে হয়নি। ফলে বের্শেন ধরে নিয়েছিল যে তার প্রতি ওই মহিলার অপত্যস্নেহ বর্ষিত হবে।

সে তার নিজের দুটি লাগেজ থেকে জিনিসপত্র বের করে গুছিয়ে রাখতে লাগল। তার চিরকালের গোছানো স্বভাব। বিছানার পাশে সে রাখল মনির ছবি। বাবা মায়ের ছবি বিছানা থেকে একটু দূরে রাখা দেরাজের উপরে। তার পাশে চুলের ব্রাশ, স্বরলিপির খাতা আর ক্যামেরা। ডেস্কের উপর রাখা হল আরেকটা ছবি, গের্ট আর ইনেস ঝুঁকে বসে ফ্লককে আদর করছে। এই ছবিটা রূপোলি ফ্রেমে বাঁধিয়েছে বের্শেন। এই ঘরে ডেস্ক না থেকে যদি একটা পিয়ানো থাকত, তাহলে খুব ভাল হত। তবে বাড়িওয়ালি জানিয়েছেন যে সামনের রাস্তা ধরে কিছুটা গেলেই বামদিকে বাদ্যযন্ত্রের একটা বেশ বড় বিপণি আছে। বের্শেন দরকার হলে সেখানে গিয়েও অভ্যেস করতে পারে। এই খবরটা পেয়ে সে কিছুটা আশ্বস্ত হয়। তার তখনি সেখানে যেতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু তার এখন বেশ খিদে পেয়েছে। বেলা প্রায় দু’টো বাজে। আজ সকালে তার প্রাতরাশ করাও হয়নি।

খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে প্যারিসের মানচিত্রটা খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। এখানে আসবার আগে এই মানচিত্রটা তার মা সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন। সে এখন যেখানে বসে আছে, জায়গাটা ওডিয়নের কাছে। লুক্সেমবুর্গ প্যালেস আর বাগানও খুব কাছে। ইচ্ছে হলেই সে ওই বাগানে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে পারবে। মোঁপার্নাস্সে অবধিও সহজেই চলে যেতে পারবে সে। তবে রিভ দ্রোয়াত এখান থেকে অনেকটা দূরে। তার শিক্ষক যেখানে থাকেন, সেই জায়গাটা, অর্থাৎ পাস্‌সি, সেটাও অনেকটা দূরে। সেখানে পৌঁছাতে তার ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যাবে। অনেকটা দূর যেতে এখন একটুও ভাল লাগছে না তার। ভারি স্বরলিপির ফোল্ডারটা হাতে নিয়ে বাসে কিম্বা মেট্রোতে এতখানি সে কী ভাবে যাবে, সেটা চিন্তা করতে লাগল। তাছাড়া হেঁটে হেঁটে এতদূর যাওয়া সম্ভব নয়। নিজের ফ্যাকাসে হাতের দিকে চেয়ে রইল সে। ফোল্ডার বয়ে বয়ে হাতে ব্যথা হয়ে, হাত শক্ত হয়ে ফুলে যাবে, ভাবতে লাগল সে। বাজনা বাজাবার জন্য হাত ঠিকঠাক রাখা খুব জরুরি।

অবশেষে পাস্‌সিতে বের্নহার্ড তার শিক্ষকের বাড়িতে ঠিকঠাকভাবেই পৌঁছেছিল। তবে সেখানে যাবার পরে সব কিছুই অন্যরকম মনে হয়েছিল তার। জায়গাটা তার ভাবনা, তার কল্পনার চেয়েও সুন্দর। বন্ধুত্বপূর্ণ চেহারার এক কিশোরী তাকে ভেতরে নিয়ে গেল। গানের ঘরের দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। পুরু কার্পেটে পা ডুবে যাচ্ছিল তার। দেওয়ালে অনেক ছবি ঝুলছে, যেগুলোর কোণে স্বাক্ষর করা। ঘরের বিশাল জানালা দিয়ে বিকেলের রোদ্দুর ঢুকে ঘরটাকে আলোকিত করে রেখেছে। ঘরের মধ্যে বিশাল একটা পিয়ানো অদ্ভুত আধিপত্য বিস্তার করে দাঁড়িয়ে আছে। স্বরলিপির কাগজে ঢেকে গিয়েছে বাদ্যযন্ত্রটার দেহ।

বের্নহার্ড দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পিয়ানোটার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। বাম হাতটা সে পিয়ানোর চাবিগুলোর উপরে রাখলো এবং লক্ষ্য করল যে তার হাত একটু একটু কাঁপছে। সবে দু’ দিন হল সে বাড়ির বাইরে। একটা গোটা দিন অবশ্য কেটেছে যাত্রাপথে। একটা অজানা একাকিত্ব তাকে ঘিরে ধরেছে। নিজেকে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন এবং বিপন্ন মনে হয়েছে। পথে অজস্র মানুষ হেঁটে চলেছে স্রোতের মত। কাউকে সে চেনে না। তাদের কারো সঙ্গে তার কোনও দরকার নেই। এক অন্ধ মানুষের মত ঘুরে বেড়িয়েছে পথে পথে। একটা দোকানের জানালা থেকে আরেকটা দোকানের জানালায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সে, যদিও তার বিশেষ কিছু কেনাকাটি করবার প্রয়োজন ছিল না। লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে; পা ব্যথা করছিল । নতুন নতুন রাস্তা যেন খুলে গিয়েছে তার সামনে। সে ইচ্ছেমত যে কোনও একটা ধরে চলতে পারে। ঠাকুমার বাড়িতে থাকাকালীন একটা নির্দিষ্ট সময়ে তাকে ফিরতে হত। খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি বাঁধাধরা রুটিন ছিল। এখানে সেরকম কোনো ব্যাপার নেই। কেউ অপেক্ষা করে বসে থাকবে না তার জন্য। দিনের সময়টা অন্তহীন মনে হচ্ছে। রাতও সেরকম। শুরু নেই। শেষ নেই কোনোখানে। রাতে বারবার ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল তার। মাঝে একবার উঠে জল খেল সে। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল আবার। অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখছিল সে। তারপর যখন ঘুম ভাঙল, সে জানালার শাটারের ফাঁক দিয়ে হালকা আলোর রেখা দেখতে পেল। তার মনে হল যে ভোর হয়েছে।

বাড়িতে থাকাকালীন এমন আলো দেখে সে ভোরের কথাই ভাবতো। ঊষার প্রথম কিরণ, কুয়াশাজড়ানো ভোর। কিন্তু এখানে প্রায় নটা বেজে গিয়েছে। বের্নহার্ড লাফ দিয়ে উঠল বিছানা ছেড়ে। তবে উঠেই মনে পড়ল যে তাড়াহুড়ো করে কোনও লাভ নেই। সে বেল বাজিয়ে প্রাতরাশ চাইল। তাকে একটা ট্রেতে সাজিয়ে দুধ ছাড়া এক কাপ কালো কফি আর একটা লম্বাটে রুটি দেওয়া হল। খেয়ে পেট ভরল না তার। একপাশে সরিয়ে রাখল সে ট্রেটা। তারপর আবার চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। ধূসর সিলিংএর দিকে তাকিয়ে রইল সে। এই মুহূর্তে ধূসর রংটা দেখে তার এত অসহ্য লাগছে যে কহতব্য নয়। অতীতে এরকম বিশ্রী দেখতে কখনই মনে হয়নি তার এই রঙটাকে; কেমন যেন নোংরা আর বিষণ্ণ। তার মন হতাশায় আর বিরাগে ছেয়ে গেল। যে দিনটা শুরু হবে, সেই দিনটার প্রতি এবং নিজের প্রতি অবিশ্বাসে মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল।

সারা সকাল জুড়ে ওই সিলিং-এর ধূসরতা তাকে তাড়না করতে লাগল; তার মনে হল শহরটার আকাশ, বাড়িঘরদোর, পথঘাট সব… সবকিছুই যেন ধূসরতায় ডুবে গিয়েছে। পাস্‌সি যাবার পথে যে সাবওয়েতে সে ঢুকেছিল, সেখানেও তার মনে হয়েছিল যে তার চোখে যেন একটা ধূসর পর্দা পড়ে গিয়েছে। নিজেকে কেমন যেন অনুভূতিহীন, ভোঁতা, ব্যথাতুর, অকর্মণ্য বলে মনে হচ্ছিল তার।

ধূসর বিষাদ পেরিয়ে এখন এই পিয়ানোর সামনে দাঁড়িয়ে বের্শেন নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। এই মুহূর্তে এই বিরাট শহরে সে একাকী নয়। এখনই এক পরিচিত এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কণ্ঠ তাকে সম্বোধন করবে; সে এমন একজনকে দেখবে যিনি গের্টকে চেনেন (কারণ বহুবার সঙ্গীতের ক্লাস শেষ হলে গের্ট তাকে গাড়িতে করে আনতে যেত); হঠাৎ গের্টের কথা ভেবে অপ্রত্যাশিতভাবে বের্শেনের বাড়ির জন্য মন খারাপ হল। মনে হল যে সে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না, এখনই তার চোখে জল আসবে।

তার শিক্ষক পাশের ঘর থেকে এসে তার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন। বের্শেন উত্তেজনায় কাঁপছিল। … ‘ভয়লা দোঙ্ক লে পেতিত কোরাজোঁ’*- উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন শিক্ষক। হৃদ্যতাপূর্ণ প্রবল স্বরে বের্শেনকে জানালার আলোর কাছে নিয়ে এলেন তিনি, ‘তারপর, কেমন আছেন আপনি? পথে কোনো সমস্যা হয়নি তো? কোথায় উঠেছেন? জায়গাটা ভাল তো? আপনি কঠিন পরিশ্রম করবার জন্য তৈরি তো?’

বের্শেন একটু ঘাবড়ে যায় এত প্রশ্নের সামনে। কারণ, ফরাসি ভাষায় তার খুব বেশি দখল নেই। সে অসহায়ভাবে মাথা নেড়ে যায় নিজের অস্বস্তি গোপন করার জন্য।

-‘আমি কিছু কিছু অভ্যাস করেছি।’ … বলে সে শিক্ষকের অনুমতির অপেক্ষা না করেই পিয়ানোর সামনে বসে পড়ে; বসে তার নিজেরই একটু বিব্রত বোধ হয়। অস্বস্তি কাটানোর জন্য সে জোরে জোরে হাতের আঙুল ঘষতে থাকে।

শিক্ষক অনুমতি দেবার ভঙ্গি করে মাথা নাড়েন… ‘চলুন, বাজাতে শুরু করুন। অসুবিধে নেই। আমি আমার এক বন্ধুকে খবর দেব, যিনি আপনার বাজানো শুনে খুব খুশি হবেন।’

বের্শেন গত বেশ কয়েক মাস বাখের কম্পোজিশন বাজায়নি। তবুও সে চুপচাপ বাজানো শুরু করল। বাজাতে বাজাতে সে চারপাশের দুনিয়া ভুলে এক ধ্যানের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল। সুরের প্রদীপ্তির আবেশ তাকে ঘিরে রেখেছিল। বাজাতে বাজাতে এক মুহূর্তের জন্য চোখ তুলে সে একজন অচেনা মানুষকে দেখতে পেল। সেই মানুষটি একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। পিয়ানোর ঢাকনার উপরে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি। বের্নহার্ডের একটু অদ্ভুত লাগে তাঁর দিকে তাকিয়ে; মুখমণ্ডলে মধ্যে গভীর এক বিষাদ ছেয়ে আছে; তাঁর মুখখানা ভারি ফ্যাকাসে। ঘরের আলোটা ততখানি উজ্জ্বল নয় বলেই তাঁর মুখখানা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে কি না, সেটা সে বুঝতে পারে না। সে তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে মন কেন্দ্রীভূত করে পিয়ানোর চাবির উপরে। সুরের মায়ায়, ঐন্দ্রজালিক স্বপ্নের মাঝে ডুবে যেতে যেতে নেশাগ্রস্তের মত বাজাতে থাকে সে।

(চলবে)



* Voilà donc le petit courageux- ফরাসি ভাষার এই বাক্যবন্ধের অর্থ… ‘তাই তো এই ছোট্ট সাহসী মানুষটি এসেছে।’
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৯.২

এসব তো সকালের ঘটনা। বেলা গড়িয়ে দুপুর হবার আগে থানায় দু’পক্ষেরই রিপোর্ট লেখানো হয়ে
গেল। যার থেকে বোঝা গেল যে স্কুল মাস্টারের দল মারামারি করেছে এবং একে অপরকে খুন করতে
চাইছিল। কিন্তু তখন ওদের থামানোর জন্য কেউ ছিল না। তাহলে একটাও খুন হল না কেন?
পুলিশের মনে এই স্বাভাবিক প্রশ্ন ওঠায় ওরা এবার উলটো দিক থেকে তদন্ত শুরু করল।

সেদিন দুপুরের দিকে বৈদ্যজীর বৈঠকখানায় এ’নিয়ে ভারি কাটাছেঁড়া শুরু হল। সেখানে হাজির সাধারণ
নাগরিকদের মনে হল—ব্যাপারটা আরও একটু গড়ালে ভাল হত। ঠিক আছে, নিজেদের কারও হাড়
ভাঙেনি—সেটা ভাল, তবে খানিকটা রক্ত বেরনোর মত চোট লাগা উচিত ছিল। তবেই দুশমনদের
বিরুদ্ধে একটা খাসা মামলা দাঁড়াতে পারত। শনিচর ভাবল—গ্রামপ্রধান নির্বাচিত হওয়ার আগে
আরেকটু নেতাগিরি করে নিই। অতএব, নিঃশুল্ক উপকার করার চেষ্টায় বলল,-- প্রিন্সিপাল রাজি
হলে আমি ওনার হাতে কোঁচ দিয়ে খোঁচা মেরে রক্ত বের করে দিই? তাহলে ওটাও খান্না মাস্টারের
কাজ বলে থানায় লিখিয়ে দেয়া যাবে।
কিন্তু ছোটে পালোয়ান ওকে দূর দূর করে চুপ করিয়ে দিল।
সেই দুপুরে রঙ্গনাথ এবং রূপ্পনবাবু চুপচাপ সবার কথা শুনছিলেন, নিজে একবারও মুখ খোলেননি।
সেটা অবশ্য শিবপালগঞ্জে বোকামির চিহ্ন। আসলে ওরা ভেতরে ভেতরে প্রিন্সিপালের উপর রাগে
ফুঁসছিলেন। খানিক বাদে রূপ্পন বাইরে এসে বললেন—এই শালা বাবাকে কোর্ট-কাছারির দিকে নিয়ে
যাচ্ছে, এরপর জেলের ভাত খাইয়ে তবে শান্ত হবে।
এদিকে বৈদ্যজী সেই দুপুরে প্রিন্সিপালের মুখে খান্না মাস্টারের উৎপাতের গল্প গম্ভীর মুখে
শুনছিলেন। শেষে এমন একটা কথা বললেন যার সঙ্গে এই মামলার কোন সম্পর্ক নেই। কথাটি
একদম সত্ত্বগুণ সম্পন্ন এবং সেটা কোন লোককে নীরোগ করে দেবার জন্য যথেষ্ট।
উনি বললেনঃ
“জেলা স্কুল ইনস্পেক্টরের ধর্মে মতি দেখে আমি তো হতভম্ব। গত মঙ্গলবার শহরে যেতে
হয়েছিল। দেখলাম, একজন লোক হনুমানজীর মন্দিরের সামনে মাটিতে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করছে।
যখন ধূলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল দেখি আর কেউ নয়—আমাদের জেলা স্কুল ইনস্পেক্টর। চোখ থেকে,
কী আর বলব, প্রেমের অশ্রুধার বইছিল। আমি নমস্কার করায় উনি প্রতি নমস্কার করে রূদ্ধ
সরে ‘হাউ হাউ’ করে কীসব বলে ফের চোখ বন্ধ করলেন।
“ পরের বার পাঁচ -ছয় সের উত্তম ভৈঁসা ঘি নিয়ে যেতে হবে। এমন ধার্মিক মানুষ! খামোখা ডালডা
বনস্পতি খেয়ে খেয়ে ধর্ম নষ্ট করছে।
মহাকালের লীলা”।
একটা পুরনো শ্লোক ভুগোলের একটি উপপাদ্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সেটা হল—সূর্য কোন
নিয়ম মেনে পূর্বদিকে উদিত হয় না, বরং যেদিকে ওঠে সেটাই পূবদিক হয়ে যায়।তেমনই উঁচু স্তরের
সরকারি আমলা কাজের প্রয়োজনে ট্যুর করেন না। তিনি যখন ইচ্ছে যেদিকে যান, তখন সেখানেই
প্রয়োজন সৃষ্টি হয়। এই নবীন সূর্য সিদ্ধান্তের নিয়ম মেনে এক মহাপুরুষ সেদিন বিকেল চারটে
নাগাদ শহর থেকে মোটরগাড়ি চড়ে গ্রামের পথে যাচ্ছিলেন। পথের চারপাশে ঘন সবুজের সমারোহ
দেখে উনি নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিলেন—হ্যাঁ, গতবছর যে লেকচার দিয়ে গেছলেন তার ফলেই
এদিকের গাঁয়ে এবার রবি ফসলের বাড়-বাড়ন্ত। চাষির দল ওনার পদ্ধতি মেনেই চাষ করেছে।

ওরা বুঝতে পেরেছে যে এই খেতগুলো লাঙল দিয়ে চষতে হবে। আর তাতে খালি সার দিলে হবে না,
বীজও বুনতে হবে। এই সব তত্ত্ব ওরা বুঝে নিচ্ছে এবং নবীন পদ্ধতির চাষের ব্যাপারে ওদের ভয়
দূর হয়েছে। কিসান এবার প্রগতিশীল হয়েছে, তবে ওরা আজও আগের মত চাষা-কে- চাষাই রয়ে
গেছে, সেজন্যেই পিছিয়ে পড়েছে।
মোটরগাড়ি চলছে তীব্র বেগে, আর রাস্তায় এঁকেবেঁকে চলতে থাকা লোকজন ঝড়ের মুখে শুকনো
পাতার মত উড়ে উড়ে রাস্তার কিনারে সরে যাচ্ছে। ফের নিজেকে ধন্যবাদ! যত আলসে নাগরিক ওঁর
মোটরের গতিবেগের ধাক্কায় কেমন চটপটে হয়ে উঠছে! দেখ, ওরা কেমন চালাক হয়ে গেছে! এমন
দ্রুতবেগে চলা গাড়ির চাকায় ওদের একটা বুড়ো আঙুলও পিষে যায়নি! উনি পরম সন্তোষে একবার
নিজেকে, ফের একবার গোটা ভারতকে বললেন—সাবাশ! তোর ভবিষ্যৎ উজ্বল বটে।
গাড়ি ছঙ্গামল ইন্টার কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছে। আন্ডারওয়ারের উপরে বুশশার্ট এবং
ডোরাকাটা পাজামার উপর গেঞ্জি -ছাড়া- জামা পরা ছেলের দল নালার পাশে ছোট্ট পুলের উপর
বসেছিল। দুটো দল নিজেদের মধ্যে তিতির-বুলি’র সাংকেতিক ভাষায় কথাবার্তা চালাচ্ছিল। সাহেব
এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশে বুঝে ফেললেন যে এরাই ছাত্র।
গাড়ি প্রায় এক ফার্লং এগিয়ে গেছল। কিন্তু মহাপুরুষের খেয়াল হল যে গত আটচল্লিশ ঘন্টায় উনি
নবযুবকদের কোন লেকচার দেননি। হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে এই তাজা তরুণদের জন্য উনি কত না
দুঃখ সয়েছেন! ওদের ভালর জন্যেই উনি গ্রামে নিজের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে শহরে এসে বাংলোয়
থাকছেন। পুকুর পাড়ে বসে থাকার বদলে সকাল-সন্ধ্যে একটা ছোট্ট কামরায় বসে থাকার অভ্যেস
করেছেন। নিজেকে কত বদলে ফেলেছেন!
যেই মনে হল যে ওনার বিশেষ পছন্দের নওজোয়ানদের সঙ্গে গত আটচল্লিশ ঘন্টায় কোন
কথাবার্তা হয়নি, অমনই খেয়াল হল—আরে! এতক্ষণ বিনা লেকচার ঝেড়ে রয়েছি? আমার মনে এত
ভালো ভালো চিন্তা উঁকি দিচ্ছে আর আমি কিনা সেসব স্বার্থপরের মত নিজের কাছে চেপে রেখেছি?
সত্যি, আমি আজকাল বড্ড কিপটে হয়ে গেছি। ধিক্‌ ধিক্‌! এই দেশে জন্মেও এতক্ষণ মুখ বন্ধ?
আটচল্লিশ ঘন্টা! মানে ২৮৮০ মিনিট? আর ৬০ দিয়ে যদি গুণ করি তো যা হবে তত সেকেন্ড; –
আচ্ছা, কত সেকেন্ড? এতটা সময় নওজোয়ানদের উৎসাহ দিতে কিছু জ্ঞান বিতরণ না করে
রয়েছি! আমার হলটা কী? পক্ষাঘাত নয় তো!
এক পলকে উনি ডিসিশন নিলেন—ড্রাইভার, গাড়ি ঘোরাও! এই কলেজটার স্ন্যাপ ইনস্পেকশন
করব।
উনি কলেজে পৌঁছে গেলেন আর ছুটির ঘোষণা হয়ে গেল। ছেলের দল ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে মাঠে
বসে পড়ল। স্থানীয় সরকারি আমলা, মাঠে ঘাটে কড়ি খেলার জুয়াড়ির দল, তাড়িখানায় বসে থাকা
নেশাখোর—সবাই দেখতে দেখতে এসে ভীড় জমিয়ে দিল। বেশ বড়সড় মিটিং হয়ে গেল। এরা না
এলেও মিটিং হত। বক্তা নির্লজ্জ হলে একটা ল্যাম্পপোস্টকেও শ্রোতা বানিয়ে একাই মিটিং করে
নেয়। কিন্তু এখানে তো সত্যি সত্যি ভালরকম মিটিং হল।
ছেলেপুলের ব্যাপারটাই এ’রম। ওদের ক্লাসের মধ্যে আটকে রাখ তো কলেজ হয়, আর ক্লাস থেকে
বার করে খোলা মাঠে ছেড়ে দাও তো মিটিং!
উনি ছেলেদের বোঝালেন যে ওরাই দেশের ভবিষ্যৎ আর মাস্টারদের বোঝালেন যে ওরাই দেশের
ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে। ছাত্র এবং মাস্টার এসব আগে থেকেই জানত। উনি ছেলেদের ধমকাতে
লাগলেন – কেন ওরা, আটচল্লিশ ঘন্টা তো দূর, আটঘন্টাও চুপ করে শুনতে পারেনা। তারপর উনি
টিচারদের ধমকালেন—কেন ওরা ছেলেগুলোকে সংযম শেখাচ্ছে না? উনি নালিশ করলেন—এই

ছোকরাগুলো জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীতের বিষয়ে কিচ্ছু জানে না। আর মাস্টারের দল এসব
দেখেও খালি মাগ্যিভাতা বাড়াও, বেতন বাড়াও বলে চেঁচায়।
মাস্টার এবং ছেলের দল এসব নিয়ে তলিয়ে ভাবার আগেই ঊনি অন্য বিষয়ে বলতে শুরু করলেন। সেই
বিষয়, যেটা স্কুল-কলেজে লেকচার দিতে আসা সব মহাপুরুষই না বলে ছাড়ে না।
বললেন—“আমাদের শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। এই ব্যবস্থায় পড়াশুনো করে সবাই খালি ক্লার্ক হতে
চায়”।
ছাত্রদের পরামর্শ দিলেন যে এই শিক্ষা-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা দরকার। উনি অনেক
বিদ্বান, বিশেষজ্ঞ এবং শ’য়ে শ’য়ে সমিতি ও কমিশনের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে বোঝালেন যে
বর্তমান শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। বিনোবাজী এবং গান্ধীজির নামও বাদ পড়ল না। তখন কলেজের
ম্যানেজার বৈদ্যজীও মাথা হেলিয়ে সায় দিলেন-- আমাদের শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। তারপর কলেজের
প্রিন্সিপাল, ওঁর দলের মাস্টার, যত ভবঘুরে, নেশাড়ু সবার মাথা নাড়ানোর পালা। এইভাবেই ওরা
মেনে নিল যে আমাদের শিক্ষা- পদ্ধতি খারাপ। এবার উনি বললেন - গত শতাব্দীর শিক্ষা পদ্ধতি
যে ভালো ছিল তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ হল সবাই সাত তাড়াতাড়ি বুঝে গেল-- আমাদের শিক্ষা-
পদ্ধতি খারাপ।
ছাত্রদের বললেন যে ওদের উচিৎ চাষ করা, দুধ খাওয়া, শরীর চর্চা করা, আর আগামী দিনের
নেহেরু-গান্ধী হবার জন্য তৈরি থাকা। মুশকিল হল, এসব ছেলের দল ওনাকেও বলতে পারত। এসবের
পর উনি সমন্বয়, দেশের ঐক্য, রাষ্ট্রভাষা প্রেম ইত্যাদি হরেক বিষয়ে এক একটি বাঁধাগতের
বুলি বলে , কলেজের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার বার্ষিক আশ্বাস দিয়ে, কিছু মেওয়া ইত্যাদি খেয়ে,
চা খেয়ে ফের ঘন্টায় সত্তর মাইল বেগে ফুরুৎ হয়ে গেলেন। মাস্টার আর ছাত্রের দল খানিকক্ষণ
ওনার “ভাইয়োঁ ঔর বহেনোঁ’ জাতীয় বাঁধা বুলির নকল করে যে যার ঘরে চলে গেল। ফলে শিক্ষা-
পদ্ধতির আমূল পরিবর্তনের গুরু দায়িত্ব এসে পড়ল কলেজের মালী, চাপরাসি ও মজুরদের ঘাড়ে।
ক্লার্ক মেওয়ার প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখল মাত্র একটা কাজু পড়ে রয়েছে। সেটা তুলে ময়ূখে
দিতে গিয়ে কী ভেবে নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলল।

(চলবে)
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in








তেইশ

লালজি মন্দির চত্বরটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। লম্বা-চওড়ায় ৫৪ ফুট বর্গাকার মন্দিরটি প্রায় চার ফুট বেদির ওপর অবস্থিত। মন্দিরের সামনে আছে চারচালা নাটমন্দির। চত্বরে প্রবেশপথের উপরে আছে নহবতখানা। বাঁ-দিকে রয়েছে পর্বত আকৃতির গিরিগোবর্ধন। মূল মন্দিরের চারদিকে চারচালা ছাদযুক্ত দীর্ঘ এবং ত্রিখিলান বারান্দা আছে। প্রথম তলের ছাদের চার কোণে সৃষ্ট খাঁজে তিনটি করে---দুটি চূড়া সমউচ্চতায় এবং মাঝেরটি একটু পেছোনো অবস্থায় সমতল করে বসানো আছে। দক্ষিণমুখী মন্দিরের সম্মুখভাগে আছে ত্রিখিলান প্রবেশদ্বার। মন্দিরের সম্মুখভাগ টেরাকোটা অলংকরণ সমৃদ্ধ। রামায়ণ, নানা পৌরাণিক কাহিনির ফলকের পাশাপাশি নামের সঙ্গে সাজুয্য রেখে মন্দিরের টেরাকোটা অলংকরণের অনেকটা অংশ জুড়েই আছে কৃষ্ণলীলার নানা কাহিনির প্রতিফলন।

লালজি মন্দিরের বর্তমান বয়স ২৮০ বছর। ১৯৫৪ সালে জমিদারি উচ্ছেদের পর রাজবাড়িচত্বর প্রায় ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছিল। তার অন্তত ৪৫ বছর পর সমগ্র চত্বরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কলকাতা মণ্ডল অধিগ্রহণ করে। চত্বরের সৌন্দর্যায়নের কাজটি চমৎকারভাবে হলেও স্থাপত্য রক্ষণাবেক্ষণের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট নন সাধারণ মানুষ।

রিমির মনটা আনবাড়ির আঙিনার ধুলোয় বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে মনটা।সকালে উঠে সমীরণের উঠোন ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে।তুলসীতলায় প্রদীপ দেয়।বিপিন ও সমীরণ হরিনাম করে।রিমি খোল বাজায়।

পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার অন্তর্ভুক্ত এই সতীপীঠ আমার জন্মস্থান বড়পুরুলিয়া গ্রামের কাছাকাছি। তাই বারবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে সতীপীঠে।

সত্য যুগে দক্ষ যজ্ঞে সতী শিবের নিন্দা সহ্য করতে না পেরে আত্মাহুতি দেন। এর পর মহাদেব কালভৈরবকে পাঠান দক্ষকে বধ করতে। সতীর দেহ নিয়ে তিনি শুরু করেন তাণ্ডবনৃত্য। ফলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ বিভিন্ন ভাগে খণ্ডিত করেন। এই অংশ গুলো যেখানে পরেছে সেখানে মন্দির তৈরি হয়েছে। এগুলোকে সতীপীঠ বা শক্তিপীঠ বলে। এগুলি তীর্থে পরিণত হয়েছে। পীঠনির্ণয়তন্ত্র তন্ত্র মতে দেবীর বাম বাহু পড়েছিল বহুলায়। পরে রাজা চন্দ্রকেতুর নামানুসারে এই গ্রামের নাম হয় কেতুগ্রাম ।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন।সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব এই দেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তান্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খন্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহ খন্ড গুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। সেই রকমই একটি সতীপীঠ হলো “বেহুলা” বা “বহুলা” সতীপীঠ।অন্নদামঙ্গল গ্রন্থে এটিকে আবার “বাহুলা” পীঠ বলে উল্লেখ করা আছে এবং এখানের অধিষ্ঠিত দেবীকে “বাহুলা চন্ডিকা” বলা হয়েছে। আবার “শিবচরিত গ্রন্থ” অনুযায়ী কেতুগ্রামেরই ‘রণখন্ড’ নামে একটি জায়গায় সতীর ‘ডান কনুই’ পড়েছে। এখানে অধিষ্ঠিত দেবীর নাম বহুলাক্ষী ও ভৈরব মহাকাল।

বর্ধমানের কাটোয়া থেকে সতেরো কিলোমিটার দূরে কেতুগ্রামে বহুলা সতীপীঠ অবস্থিত। অনেক বছর আগে এই গ্রামে তিলি বংশজাত ভূপাল নামক এক রাজা বাস করতেন। সেই রাজার একটি ছেলে ছিল, তার নাম চন্দ্রকেতু। মনে করা হয় চন্দ্রকেতুর নামেই এই গ্রামের নাম হয়েছে কেতুগ্রাম। প্রাচীনত্ত্বের বিচারে এই কেতুগ্রামের বয়স অনেক। অনেকের মতে এই কেতুগ্রামেই জন্মেছিলেন নানুরের বিশালাক্ষী-বাশুলি দেবীর উপাসক চন্ডীদাস। এই গ্রামে ছিল তার আদি বাসস্থান। এই কেতুগ্রামের উত্তরদিকের একটি জায়গাকে স্থানীয় মানুষজন চন্ডীভিটা বলে সম্বোধন করে থাকে। গ্রামেই অবস্থান বহুলা মায়ের মন্দিরের। রাও পদবিধারী জমিদারেরা বহুলা দেবীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। বর্তমানে মন্দিরের যে সেবাইতরা রয়েছেন তারা এই রাও জমিদারদের বংশধর। এই কেতুগ্রামে “মরাঘাট মহাতীর্থ” বলে একটি জায়গা রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে শিবচরিত গ্রন্থে রণখন্ড বলে যে জায়গার উল্লেখ করা আছে সেটি আসলে কেতুগ্রামের মরাঘাট মহাতীর্থ নামক জায়গাটি। এখানেই দেবীর দেহখন্ড পড়েছিল। এই মরাঘাটের পাশ দিয়ে ছোট নদী বয়ে গেছে। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে মরাঘাট মহাতীর্থ অনেক বছর আগে শশ্মান ছিল। শশ্মানের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর তীরে মৃত শিশুদের দেহ পোঁতা হতো। এখানে অনেক সাধক সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন। এখানেই রয়েছে দেবীর ভৈরব ভীরুক। তবে এটা নিয়ে মতান্তর আছে। অনেকের মতে কেতুগ্রামে বহুলা দেবীর সাথেই ভৈরব ভীরুকের অবস্থান। আবার অনেকের মতে কেতুগ্রাম থেকে একটু দূর “শ্রীখন্ডে” আছে মায়ের আসল ভৈরব ভীরুকের লিঙ্গ ও মন্দির।

সমীরণ বলে,গ্রামে মায়ের যে মন্দির আছে, সেটিকে নতুন ভাবে সংস্কার করা হয়েছে। মন্দিরে দেবীর মূর্তিটিকে একটি কালো পাথরের উপর স্থাপন করা হয়েছে। দেবীর মুখ বাদে সারা শরীর সুন্দর বস্ত্র দ্বারা আবরণ করা থাকে। মায়ের মূর্তির চারটি হাত। মায়ের পাশেই রয়েছে অষ্টভুজ গণেশের মূর্তি। গণেশের এই মূর্তিটি অনেক পুরানো। মা এখানে স্বামী পুত্র নিয়ে একসাথে বাস করেন। এখানে দেবীর নিত্য পুজো করা হয়। মাকে রোজ অন্নভোগ দেওয়া হয়। মন্দিরের পাশে একটি পুকুর আছে, অনেকের বিশ্বাস এই পুকুরে অবগাহন করলে রোগ ভালো হয়ে যায়।
0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in





















১৯.১

জানুয়ারী মাসের আদ্দেক পেরিয়ে গেছে। এরপর ফেব্রুয়ারি এলে গ্রামসভার নির্বাচন হবে। ফের মার্চ মাসে হাইস্কুল আর ইন্টারমিডিয়েট কলেজের পরীক্ষা শুরু হবে। এই নির্বাচন একদিকে শনিচর ও বদ্রী পালোয়ানের কুস্তির আখড়াকে এবং অন্যদিকে রামাধীন ভীখমখেড়ী ও তার জুয়াড়ি সেনাপতিদের প্রজাতন্ত্রের সেবা করতে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এখন পর্য্যন্ত এদের সেবা করার বিশেষ পদ্ধতি বলতে যা দেখা যাচ্ছে তা হল বিরোধী দলকে পর্দার পেছনে গালমন্দ করা।

সবার আশা ফেব্রুয়ারি এসে গেলে এসব মুখোমুখি শুরু হবে। মার্চের পরীক্ষার কথা? এখনও কেউ ফাঁসে নি। ছাত্রের দল, অধ্যাপককুল, বিশেষ করে প্রিন্সিপাল সাহেব –কারও কোন হেলদোল নেই।

কিন্তু প্রিন্সিপাল সাহেব অন্য এক মামলায় ফেঁসে গেছেন। কিছুদিন আগে, কলেজ কমিটির বার্ষিক সভায় বৈদ্যজীকে সর্বসম্মতিতে ফের ম্যানেজার নির্বাচিত করা হয়। এটা নিয়ে কিছু সদস্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে নালিশ করেছেন। ওদের বক্তব্য—প্রস্তাবের বিরোধী সদস্যদের সভায় ঢুকতেই দেওয়া হয়নি, বরং আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ধমকানো হয়েছিল।

এই কথাটা চিঠিতে এত ফেনিয়ে লেখা হয়েছে যে ওটা পড়াই এক কঠিন কাজ। আর পড়লেও বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ, চিঠির পুরো বিবরণ সত্যি হলে মেনে নিতে হয় যে শিবপালগঞ্জে কোন নিয়ম কানুন নেই, থানা-পুলিশ বলতে কিছুই নেই, ওখানে গোটা চারেক গুণ্ডা মিলে যা খুশি তাই করে চলেছে।

এটা স্পষ্ট-- এই নালিশ যে মিথ্যে সেটা বুঝতে কোন তদন্তের আবশ্যকতা নেই। তবু বিরোধী পক্ষের কিছু সদস্য শহরে গিয়ে ওই নালিশের কপি করে শিক্ষা বিভাগের বড় বড় অফিসারের টেবিলে জমা করে ফিরে এল। তারপর গাঁয়ে এসে রটিয়ে দিল যে নালিশের তদন্ত করতে ডিপ্টি ডায়রেক্টর অফ এজুকেশন পদের অফিসার করবেন।

উনি নাকি সাদাসিধে গরু। কিন্তু এবার বৈদ্যজীর বাপেরও সাধ্যি নেই যে ওনাকে দুইয়ে নেবে। কারণ উপর থেকে সঠিক তদন্তের হুকুম জারি হয়েছে।

প্রিন্সিপাল সাহেবকে ফাঁসাতে ওইটুকুই যথেষ্ট। উনি জানেন যে তদন্তের দিকটা বৈদ্যজী নিজে দেখবেন। কিন্তু তদন্ত শুরু হলে হাকিমদের আনাগোনা লেগে থাকবে। সেসব প্রিন্সিপালকেই সামলাতে হবে। হাকিম কলেজে এলে সবার আগে কী দেখবেন? প্রিন্সিপাল নিজেকে উত্তর দিলেন— কলেজ ভবন।

এবার উনি ভবনের সৌন্দর্য বাড়াতে কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন।

শহরে গিয়ে দেখে এসেছেন-- একটা ছোট চারাগাছ পুঁতে তার চারদিকে ইঁট দিয়ে গোল ঘিরে লাল -সাদা রঙ লাগিয়ে দিলে অবহেলায় পড়ে থাকা মাঠ কেমন বাগান সেজে ঝলমলিয়ে ওঠে! ভাবলেন, কলেজের সামনে একসারি গুলমোহর আর অমলতাস গাছ লাগিয়ে দেয়া যাক। আর হাকিমের দলবল আসার আগেই নানারঙের ইঁট দিয়ে ঘিরে দেয়া যাক।

ওঁরা আসার সময় দেখবেন নানারঙে সেজেওঠা সাফ-সুতরো কলেজভবন এবং ফিরবেন একপেট ফার্স্ট ক্লাস চা এবং নাস্তা গিলে। তাহলে আর আমার বিরুদ্ধে কী রিপোর্ট দেবেন?

প্রিন্সিপাল সাহেব এসব ভেবে জানুয়ারির হাড়কাঁপানো শীতের অজুহাত ঝেড়ে ফেলে কাজে নেমে পড়লেন। গাছ লাগাতে বছরের যে কোন সময় উপযুক্ত বটেক—চুলোয় যাক বৈজ্ঞানিক লেকচারবাজি!

উনি কলেজের পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে গর্ত খোঁড়ার তদারক করছিলেন। ওনার হাতে দুটো বই—একটা মোটা আর একটা পাতলা—দেখামাত্র মনে হবে খুব দামি। । পরনে ওনার প্রিয় কেজো পোশাক, অর্থাৎ মোজাছাড়া জুতো আর হাফপ্যান্ট। লোকে দেখে যাই ভাবুক, উনি এই পোশাকে নিজেকে বেশ চটপটে এবং চালাক ভাবেন। বইদুটোকে উনি পোষা বেড়ালের মত আদর করে ধরে আছেন।

একজন মজুর কোদাল-গাঁইতি চালানো থামিয়ে ওনাকে বলল, ‘দেখে নিন মাস্টার সাহেব, গর্ত তো এতটাই হবে’?

প্রিন্সিপাল মাথা নেড়ে বললেন, ‘হুঁহ্‌ এটা কোন গর্ত হল? একটা পাখি মুতে দিলেই উপচে পড়বে। খুঁড়ে চল বেটা, এখনও অনেক বাকি’।

এসব বলে উনি পাশে দাঁড়ানো এক মাস্টারের দিকে দর্পভরে তাকালেন। মাস্টারমশায়টি ওঁর আগে থেকেই চেনা, কারণ সে এনার খুড়তুতো ভাই। তিনিও এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলেন শত্রুপক্ষের কোন মাস্টার কাছাকাছি আছে কিনা। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে আত্মীয় ঢঙে বললেন—ভাইয়া, এই কলেজে তুমি তো এখন উদ্যান-বিশারদ!

প্রিন্সিপাল বইদুটো বুকে ঠেকিয়ে বললেন, ‘সবকিছু এদের জন্যে সম্ভব হয়েছে। তবে ব্যাটারা বড্ড কঠিন সব ইংরেজি লিখেছে। বুঝতে গেলে সাধারণ-বুদ্ধির মাথা বোঁ- বোঁ করে ঘুরবে’।

খুড়তুতো ভাই উবাচ, ‘আপনি তো লৌহপুরুষ! কলেজের এত এত কাজ, পলিটিক্সে মাথা গরম হয়ে যায়। তারপর আপনি বইও পড়ে ফেলেন! আমার তো অবস্থা হল কেউ বই পড়তে না বলুক, বরং দশ ঘা জুতো মারুক। বই দেখলে গা গুলোয়’।

প্রিন্সিপাল ফিফটি পার্সেন্ট বড়দা এবং বাকি ফিফটি পার্সেন্ট প্রিন্সিপাল হয়ে বললেন- ‘চুপ কর। এসব বলতে নেই। সফরের সময়ও বই সঙ্গে রাখি। শুধু কোট-প্যান্ট পড়লে কী হবে? তাই দেখে কেউ তোমায় অধ্যাপক বলবে ভাবছ? কোট প্যান্ট তো কুঁজো বামনও পরতে পারে’।

ভাই বলল, ‘আপনিই ঠিক। মাঝখানে বাধা দেয়া আমার স্বভাব নয়। কিন্তু আমাদের আর কুঁজো-বামনের মধ্যে তফাৎ কোথায়? এই শালার টেক্সট বুক, বুঝে নিন, পচাগলা ফল ছাড়া কিছু নয়। আমরা ছোঁড়াদের পেটে এগুলো ঠুঁসতে থাকি। কারও হজম হয়, কেউ বমি করে ফেলে’।

প্রিন্সিপাল হেসে ফেললেন। ‘কথাটা অনেক দূর অব্দি নিয়ে গেলে। কিন্তু অতি বুদ্ধিমানের মরণ নিশ্চিত’।

কথাটা বলে উনি গর্ত কতটা গভীর হল উঁকি মেরে দেখতে লাগলেন। যেন কোন বুদ্ধিমানের মরণ হলে তাঁকে এই গর্তেই কবর দেবেন।

এমনসময় ওখানে আগমন হল খান্না মাস্টারের। উনি হড়বড় হড়বড় করে এসে প্রিন্সিপালের হাতে একটা কাগজ দিয়ে বললেন—নিন, ধরুন।

প্রিন্সিপাল একবার সাহায্যের আশায় তুতো ভায়ের দিকে তাকালেন। তারপর গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে কঠোর মূর্তি ধরে অফিসারি মেজাজে বললেন—এটা কী?

--কী আবার! একটা কাগজ।

ওর দিকে বুক চিতিয়ে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন দেখে খান্না মাস্টার হিতৈষী স্বরে বলল—দিন, পড়ে শোনাচ্ছি।

--‘যান, নিজের কাজ করুন। আমাকে পড়ানোর কষ্ট নাই করলেন’। এসব উনি ঘেন্না মিশিয়ে বললেন।

খান্না দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল—এই জন্মে পড়ানোর হাত থেকে রেহাই কোথায়!

তুতো ভাই খান্না মাস্টারকে একদৃষ্টিতে দেখছিল। মালিকের বাংলোর ভেতর থেকে পোষা অ্যালসেশিয়ান রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলোকে যে চোখে দেখে। প্রিন্সিপাল অনেকক্ষণ ধরে কাগজের টুকোরোটার দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে রইলেন। প্রাচীনকালের ঋষিমুনি হলে কাগজটা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যেত। খানিকক্ষণ পরে উনি ওই কাগজটাকে খান্না মাস্টারকেই ফেরত করে দিলেন।

খান্না রেগে গেল। ‘এটা কী’?

--‘কী আবার, কাগজ’। এবার প্রিন্সিপাল মন দিয়ে গর্তের গভীরতা দেখতে লাগলেন।

খান্না মাস্টার ঠোঁট কামড়ে গলার স্বর নামিয়ে বলল, ‘যাই হোক, লিখে আবেদন দিয়েছি। আপনার আদেশ ওই আবেদনের উপর লিখে দিতে হবে’।

প্রিন্সিপাল একজন মজুরের সঙ্গে কথা বলছিলেন-‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। এবার থাম। আবে, গর্ত খুঁড়ছিস, কুয়ো নয়। ঢের হয়েছে’।

খান্না খানিকক্ষণ চুপচাপ। ফের মুখ খুলল,’আমি চারদিনের জন্য বাইরে যাব। ছুটি চাই। আপনি লিখে হুকুম দিন’।

প্রিন্সিপাল পায়ের পাতায় ভর দিয়ে গর্তের পাশে জমা ভিজে মাটির উপর বসেছেন। যাদের চোখ আছে, তারা দেখুক—কলেজের স্বার্থে উনি কাদা হোক, নালা-নর্দমা হোক, কিছুরই পরোয়া করেন না। এবার উনিমাটিকাটা মজুরদের গর্তের চারপাশে উঁচু করে আল বাঁধার ব্যাপারে বিস্তারিত নির্দেশ দিতে লাগলেন।

খান্না মাস্টারের কথাবার্তা এবার পার্শ্বসংগীতের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। তিনিও গর্তের উলটো পাড়ে পায়ের পাতায় ভর করে বসে বলে উঠলেন—‘ গর্তের ভেতর লাফিয়ে পড়ার আগে আমার কথার জবাব দিয়ে যান’।

প্রিন্সিপাল ওর দিকে খোলাচোখে তাকালেন। বললেন—‘ আগে তোমাকে ধাক্কা দিয়ে গর্তে ফেলব, তারপর তোমার উপর লাফিয়ে পড়ব। বুঝলে হে খান্না মাস্টার’! ডায়লগ মেরে উনি তুতো ভাইয়ের দিকে তাকালেন। ভাইটি একেবারে বিনয়ের অবতার হয়ে নম্রস্বরে বলল-‘যাই, চাপরাশিদের ডেকে আনি। মনে হচ্ছে ভালরকম ঝগড়া ঝঞ্ঝাট হবে। কিন্তু আমার দিব্যি, আমি ফিরে না আসা পর্য্যন্ত আপনি কিছু বলবেন না’।

--‘আমি আর কী বলব ভাই! সবকিছু মুখবুজে সহ্য করে যাচ্ছি। যেদিন ওর পাপের ঘড়া পূর্ণ হবে, সেদিন নিজে থেকেই ভক্‌ করে ফাটবে’।

প্রিন্সিপাল খান্না মাস্টারকে শাপ দিলেন নাকি? ও বেশ ঘাবড়ে গেল। ওর ভয় প্রিন্সিপাল হঠাৎ চেঁচাতে না শুরু করে—খান্না আমার গায়ে হাত তুলেছে। তারপর খান্না মামলা মোকদ্দমায় না ফেঁসে যায়!

ও চুপচাপ উঠে গর্তের থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক মাস্টারের কাছে গেল। তারপর গোটা দুনিয়াকে শুনিয়ে চেঁচাতে লাগল—ভয় দেখাবেন না মাস্টার সাহেব, ধমকি দেবেন না। এটা নবাবী আমল নয়। এত সহজে খান্নার প্রাণ যাবেনা। বলে দিচ্ছি, আমার গায়ে হাত তুলেছেন তো রক্তগঙ্গা বইবে। এই বলে দিলাম, হাঁ!

খান্না ঠিক চেঁচাতে চায়নি। কিন্তু জোর গলায় বলতে গিয়ে ব্যাপারটা চেঁচানোর স্তরে পৌঁছে গেল। কয়েকজন মাস্টার এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না। খান্না হঠাৎ বিকট চিৎকার করে উঠল—‘মারুন, মারুন না আমাকে! ডেকে আনুন যত চাপরাশির দল। ওদের হাতেই আমার অপমান হোক। থেমে গেলেন কেন’?

খাসা তামাশা জমেছে। এই সত্যি কথাটা বোঝার তাগিদে দুই দলের কিছু মাস্টার দুদিকে জড়ো হল। ছাত্রের দল এখনও আসেনি। যে দু একটা এসেছিল, তাদের চাপরাশিরা আগে থেকেই ভাগিয়ে দিল। ওরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখতে পাচ্ছিল। তবে এই তামাশা সেরেফ ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ হয়ে গেল।

প্রিন্সিপল সাহেব এই আচমকা আক্রমণে প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেছলেন। তারপর ঠেলে ওঠা ক্রোধকে সংযত করে খান্নার কাছে গেলেন। ছুটির দরখাস্তটি ছিনিয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন—‘চেঁচিও না খান্না মাস্টার! তোমার বুঝতে ভুল হয়েছে। দাও, দরখাস্তের উপর আদেশ লিখে দিচ্ছি’।

ওঁর ইশারায় তুতোভাই মাস্টার একটা ফাউন্টেন পেন বাড়িয়ে দিল। উনি হাতের হর্টিকালচারের বইটার উপর ছুটির দরখাস্তটি রেখে তার উপর খসখস করে কলম চালাতে লাগলেন। লিখতে লিখতে বললেন—‘আমাদের লড়াই নীতির। এর মধ্যে মারপিটের কথা উঠছে কেন? ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে’।

খান্না মাস্টার নিজের খাড়া করা তামাশায় নিজেই ক্লান্ত হয়ে বলল,-‘আগে এই দরখাস্তের ওপরে হুকুম লিখুন। তারপর বাকি কথা’।

তিনি মুচকি হেসে জানালেন,-‘সেটাই করছি’।

কয়েকটা শব্দের উপর উনি ‘ক্রস’ চিহ্ন লাগালে। অন্য কয়েকটায় গোল করে ঘিরে দাগিয়ে দিলেন। শেষে বড় করে ইংরেজিতে একটা শব্দ লিখলেন—‘রিজেক্টেড’!

খান্না মাস্টারের মুখ থেকে কোন শব্দ বেরোনের আগেই তিনি দরখাস্ত ওকে ফেরত দিয়ে বললেন—স্পেলিংয়ে অনেকগুলো ভুল। ‘হলিডে’ শব্দে ‘এল’ অক্ষরের পরে ‘ওয়াই’ লেখা হয়েছে। ‘খান্না’ শব্দে ‘কে’ অক্ষরটা ক্যাপিটালে লেখা নাকি স্মল বোঝা দায়। এসব খেয়াল করা উচিত’।

খান্না বাকশক্তিরহিত। তারপর হঠাৎ গণ্ডারের মত মুখ খুলে গর্জন করে উঠল—‘ একবার কলেজের বাইরে আয়! তোর সমস্ত স্পেলিং ওখানেই শিখিয়ে দেব’।

ব্যস্‌ মহারণ শুরু।