undefined
undefined
undefined
ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক২০ (১)
বদ্রী পালোয়ান গেছে পড়শি জেলায় এক নওজোয়ানের জামিনের তদ্বিরে। ছেলেটির উপর ধর্ষণ ও মারপিটের মামলা শুরু হয়েছে। যাবার আগে রঙ্গনাথকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল—ব্যাটা মহা গুণ্ডা! যেখানে যায় একটা না একটা ঝঞ্ঝাট বাঁধিয়ে ছাড়ে।
তারপর বৈদ্যজীর থেকে দেড় হাজার টাকা নিয়ে জহরকোটের ভেতরের পকেটে ঠুঁসল। রঙ্গনাথের কৌতুহল—“এতগুলো নগদ টাকা এমন ভাবে নিয়ে যাওয়া”!
বদ্রীর জবাব,” গুণ্ডা শুধু এজলাসের নীচে কাঠগড়ায় নয়, উপরেও বসে রয়েছে।হাকিম তো তা-না-না-না করে জামিন দিয়ে দেবেন। কাগজ চলে যাবে কর্মচারিদের হাতে। তারপর বিশ রকম ঝামেলা। জামিনের উপযুক্ত কাগজ কই? কাগজ তৈরি কর। সম্পত্তির নকশা নিয়ে এস। তারপর সেটার যাচাই করা—কাঁচা এবং পাকা—সব হবে। এবং পদে পদে পয়সা ঠেকাতে থাক।
“ যারা ভাল মানুষ তারা জামিনের চক্করে না ফেঁসে জেলে পড়ে থাকা পছন্দ করে। নগদ নারায়ণের ব্যাপারই আলাদা—বড় আরাম। যেই হাকিম হেঁকে বলবে—একহাজার টাকার জামিন!
অমনই দশটা সবুজ কড়কড়ে নোট টেবিলে ছুঁড়ে দিয়ে বলব—নাও ভাই! রেখে দাও যেখানে তোমার ইচ্ছে”।
রঙ্গনাথ আরও জানতে চাইছে-“ বদ্রী দাদা, ব্যাটা যখন একনম্বরের গুণ্ডা তখন কেন হাত ময়লা করছ? পচুক না ব্যাটা জেলে”!
“ গুণ্ডা কে নয়? রঙ্গনাথ বাবু, ভেবে দেখ—গুণ্ডার মাথায় কী শিং বেরোয়”?
তারপর ধীর স্বরে বলল—“ আমি খালি এইটুকুই জানি যে ব্যাটা কখনও আমার আখড়ায় চ্যালাগিরি করেছিল। বাইরের লোকের চোখে ও যত বড় গুণ্ডাই হোক, আমার চোখে ওইদিন ভাসে যখন কুস্তির আখড়ায় ও আমার ল্যাং খেয়ে ছিটকে পড়ত”।
এবার ওর গলার স্বর আরও কোমল হয়ে খাদে নেমে এল,”যাই বল, আমারই তো পোষ্যপুত্তুর বটে”!
পোষ্যপুত্তুর শব্দের অমন লাগসই প্রয়োগ দেখে রঙ্গনাথ ভির্মি খেল। তবে ওর মাথায় একটা রিসার্চ পেপার লেখার চিন্তা ঘাই মারল—‘আধুনিক ভারতে পোষ্যপুত্তুরের মহত্ত্ব’।
“এই সেদিনও আখড়ায় এসে কাঁইচি মারা শিখছিল, এখন তো পুরোদস্তুর পালোয়ান”! বদ্রীর গলায় আবেগের ছোঁয়া।
রঙ্গনাথ বুঝতে পারল যে সব পোষ্যপুত্তুরের ক্যারিয়ার এভাবেই শুরু হয়।
প্রত্যেক মহাপুরুষের আশে পাশে পোষ্যপুত্তুরদের ভীড় লেগেই থাকে। পুরুষ মহাপুরুষ হয়ে গেলেই তাঁর সম্মান রাখার দায়িত্ব পোষ্যপুত্তুরদের ঘাড়ে এসে পড়ে। ওরা ওনার ইজ্জত নিয়ে টানাটানি শুরু করে দেয়। কিছুদিন গেলে ওই ইজ্জত ফেটে গিয়ে সহস্রধারায় বয়ে চলে।লোকসভা বিধানসভার বিতর্কে সেই ধারায় ভেসে যায়। খবরের কাগজ আর বেতারে তার ছিঁটে পড়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়। সেই ধারায় পুরো গণতন্ত্র ডোবে আর ভাসে। শেষ হয় বেহায়াপনার মহাসাগরে লীন হয়ে।
বদ্রী পালোয়ান ব্যাখ্যান করতে শুরু করলঃ
“ঝগড়ার শুরু পড়শি এক বামুনকে নিয়ে---“
--- মহাপুরুষেরা সাধারণতঃ নিজের সিংহাসনে বসে পোষ্যপুত্তুরদের খেলাধুলো দেখতে থাকেন। এই দেশে মহাপুরুষ আর তাঁর পোষ্যপুত্তুর ছাড়া কিছু ঝামেলা পাকানোর লোকও থাকে। তারা কখনও সখনও মহাপুরুষের সামনে এসে চেঁচায়—“ ওগো মহাপুরুষ, তোমার পুষ্যিদের ভ্রষ্টাচার আর দুর্নীতির চোটে টেকা দায়। বড্ড বাড় বেড়েছে। তোমার ইজ্জত পাংচার হল বলে”।
এমন সময়ে মহাপুরুষেরা একটিই কাজ করে থাকেন।
“ কী বলছেন, ভ্রষ্টাচার! আসুন, আমরা সবাই মিলে আগে ঠিক করি ভ্রষ্টাচার কাকে বলে? তার সজ্ঞা কী”? রঙ্গনাথের চিন্তার স্রোত বয়ে চলে।
“তো পড়শি এক বামুন। ওর বৌয়ের ভরা যৌবন”।
ব্যস্, ওইটুকু শোনামাত্র রঙ্গনাথ তার ‘আধুনিক ভারতে পোষ্যপুত্তুরের মহত্ত্ব’ গোছের থিসিসের কথা ভুলে মনপ্রাণ দিয়ে বামুনের পারিবারিক কেচ্ছা শুনতে লাগল।
“--- আমার চ্যালা তার কাছেপিঠে কোথাও থাকত। বামুন-বৌয়ের সঙ্গে কয়েক মাস ওর ইন্টুমিন্টু চলছিল। বামুন সব জেনেও না দেখার ভান করত। একদিন হল কি, পর্দার আড়ালও রইল না। বামুন ফ্যালফ্যাল করে দেখল যে আমার চ্যালা ওর বৌকে জাপটে ধরেছে। কিন্তু সে ব্যাটা খানিক চোখ মিটমিট করে থলের মত চেহারা করে চুপচাপ কেটে পড়ল। এতে আমার চ্যালার হল মটকা গরম। ওর মন পরিষ্কার, বেশি জিলিপি প্যাঁচানো পছন্দ নয়। একলাফে এসে বামুনের ঘাড় ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল—কিঁউ বে, আমার সামনেই কেটে পড়ছিস, লাজ-লজ্জার মাথা খেয়েছিস? মরদ ব্যাটা, তোর একটু রাগও হল না? আরে সত্যিকারের মরদ হলে একবার আমাকে আওয়াজ দিয়ে দেখতিস্!
“ তো বামুন বেচারা করবেটা কী! মন্তর গোছের কিছু ফিসফিস করে আউড়ে দিল। তাতে খেপে গিয়ে আমার চ্যালা হাসিমুখে ওকে এক কাঁইচি মেরে চিৎ করে দিল। বেচারার ঊরুর হাড় গেল ভেঙে।
“তারপর চেঁচামেচি কান্নাকাটি সব শুরু হল। বামুন এবার গলা ফাটিয়ে চেল্লাতে লাগল। আবার ওর বৌ চিল-চিৎকার জুড়ল—দেখ দেখ, লোকটা আমার ইজ্জত লুটে নিচ্ছে।
এবার তুমিই বল রঙ্গনাথ বাবু, এই দুনিয়ায় কার শত্রু নেই? এতেই থানায় রিপোর্ট লেখানো হল আর আমার চ্যালা ফেঁসে গেল”।
বদ্রী পালোয়ান হাসতে লাগল, যেন খুব মজার কথা শুনিয়েছে।
রঙ্গনাথ –“কিন্তু বদ্রী দাদা, এটা কেমন হল? ----- আগে বেচারার বিবিকে --- তারপর ওকেও”--?
বদ্রীর হাসি থামছে না। “ রঙ্গনাথ বাবু, তুমি মুখ ফুটে বল, বা না বল—এটাই সত্যি। যে নিজের বৌকে সামলাতে পারে না , সে সারাজীবন বেচারাই থাকে। ওকে নিয়ে হা-হুতাশ করে কী হবে? আমার মাথাব্যথা নিজের চ্যালাকে নিয়ে”।
বদ্রী পালোয়ান ক’দিনের জন্য বাইরে যাওয়ায় রঙ্গনাথ আজ ছাতে একলাই শুয়েছে । শীত জাঁকিয়ে পড়েছে। শীতের মজা উপভোগ করবে বলে বদ্রী ওর খাটিয়া খোলা ছাতে লাগিয়ে শুচ্ছিল, রঙ্গনাথ ঘরের ভিতর।
রাত প্রায় এগারোটা। ওর ঘুম আসছে না।
খাটিয়ার পাশে একটা কাঠের বাক্সোর উপরে একটি ব্যাটারিতে চলা রেডিও রাখা। কাঠের বাক্সটিতে কলেজের জন্য বইপত্তর এসেছিল। বইপত্তর গেল প্রিন্সিপালের ঘরে আর বাক্সটা মেরামতের পর বৈদ্যজীর ঘরে। রেডিওটা কলেজের। তবে রঙ্গনাথ আসার পর কলেজ থেকে চেয়ে আনা হয়েছে। ওটা আসার পর রূপ্পনবাবুর ম্যাজিক বা কানে লাগিয়ে স্থানীয় রেডিও স্টেশন থেকে আবহাওয়ার খবর শোনার হেডফোনটা ফালতু হয়ে গেল। রেডিও সারাদিন বেজে চলে—সে ঘরে কেউ থাকুক বা না থাকুক। তবে রাতের কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম।
এ’সময় রেডিওতে শাস্ত্রীয় সংগীতের কোন প্রোগ্রাম তার শেষ নিঃশ্বাস ছাড়ছিল, এবার যেন দাঙ্গা শুরু হল। ভায়োলিন আর তবলা একে অন্যের উপর ঘন্টায় দুশো মাইল বেগে হামলা করছে। মনে হচ্ছে, ওদের দুই গাড়ি সংঘর্ষের ফলে ক্র্যাশ করে টুকরো টুকরো হল বলে। চারদিকে হাহাকার। হঠাৎ ভায়োলিন বাদক তার পাতলা তারে একটা ‘কিরররররর—‘ ধ্বনি বের করল, রঙ্গনাথের কলজে যেন বল্লমের খোঁচায় এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল! তক্ষুণি তবলায় যেন বোমা ফাটল। তাতে সঙ্গীত-নাটক-অ্যাকাডেমির ভবনের ভিত নড়ে উঠল। রঙ্গনাথ লাফিয়ে উঠে দেখতে লাগল—রেডিও আস্ত আছে তো?
নাঃ, সেটা ক্যাসাবিয়াংকার মত নিজের কাজে অচল অটল। সমানে সঙ্গীত জগতের কোস্তাকুস্তির ধারাবিবরণী দিয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে, এবার ভায়োলিন ল্যাজ গুটিয়ে পালাচ্ছে আর তবলার হামলায় আরও জোশ এসে গেছে। রঙ্গনাথ ক্লান্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে রেডিওর কান মলে দিল।
ঘন অন্ধকার! শীতের রাত তার সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে আবির্ভুতা। এ’রম সময়ে লোকের মনে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস হোক বা না হোক, ভূতের বিষয়ে বিশ্বাস জন্ম নেয়। রঙ্গনাথ ভয় পায়নি, কিন্তু ওর কেমন যেন লাগছে, অদ্ভুত কোন অনুভূতি। সত্যি বলতে গেলে এসব ভয় পাওয়ারই লক্ষণ।
কিন্তু ভয়ের চিন্তা ফিকে হয়ে গেল। কারণ, রঙ্গনাথ এখন রেডিও থেকে রূপ্পন বাবু, ফের রূপ্পন বাবুর থেকে বেলা নামে এক মেয়ের কথা ভাবছে। যাকে কখনও চোখে দেখেনি, কিন্তু কানাঘুষোয় শুনেছে যে রূপ্পনবাবু নাকি ওকে প্রেমপত্র লিখেছে!
ও জানেনা যে সেই প্রেমপত্রটি কত লম্বাচওড়া, আর কতটা গভীর। তবে গুজব হল—সেই চিঠির বাক্যগুলো নাকি অনেকগুলো সিনেমার গানের লাইন জুড়ে তৈরি। পাড়ায় বলাবলি হচ্ছে যে বেলার পিসি প্রথম সেই লাভ লেটার ঘরের এক কোণায় পড়ে থাকতে দেখে। তারপর সেটা বেলার বাবা গয়াদীনের সামনে পড়া হয়। গোড়ায় দু’একটা লাইন থেকে গয়াদীনের কিছুই বোধগম্য হয়নি।
কিন্তু তারপর এল এই লাইনটি-‘মুঝকো আপনে গল্লে (গলে) লাগালো ও মেরে হমরাহী’। এটা পড়ামাত্র গয়াদীনের জ্ঞানের কপাট ধড়াম করে খুলে গেল। বোঝা গেল এই অনুরোধ কেউ বেলাকে করেছে। চিঠির শেষ লাইন অব্দি পৌঁছতে পৌঁছতে এটার আসল চেহারা স্পষ্ট হয়ে গেল। কারণ, তাতে বলা হয়েছে—“ ইয়ে মেরা প্রেমপত্র পড়কর কি তুম নারাজ ন হো, কি তুম্মেরি জিন্দগী হো, কি তুম্মেরি বন্দগী হো”। লেখকের নাম “শ্রী রূ”।
শোনা গেছে, চিঠিটা গয়াদীন ছাড়া শুধু প্রিন্সিপাল সাহেবই দেখেছেন। তার কারণ গয়াদীন গিয়ে রূপ্পনবাবুর নৈতিক অধঃপতনের সঙ্গে, কেন যেন, প্রিন্সিপালের নামও জুড়ে দিয়েছেন। প্রিন্সিপাল ওনাকে বোঝাতে চাইলেন যে লেখাটা কোন লাভ লেটার নয়, বরং বেশ উঁচু স্তরের কাব্যসংগ্রহ। আর সেটার লেখক ‘শ্রী রূ’ হলেও তাতে কাব্যগুণ কিছু কম হয়নি। কিন্তু ভবি ভোলেনি। গয়াদীনের মতে এগুলো নোংরামির প্রমাণ। তারপরে প্রিন্সিপাল বেশ কিছু কবিতার লাইন শুনিয়ে বোঝাতে চাইলেন যে সাহিত্যে এমন সব উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি রয়েছে। তখন গয়াদীন চটিতং হয়ে বললেন—ওইসব কবিতার লাইন তোমার চরিত্র-দোষের প্রমাণ। শেষে দু’জনে মিলে ঠিক করলেন—ওই চিঠির কথা আর কাউকে জানানো হবে না।
পরের দিন থেকেই শিবপালগঞ্জের হাওয়ায় নানারকম খবর উড়ে বেড়াতে লাগল।
একটা খবরঃ খান্না মাস্টারের দলের কোন ছোঁড়া বেলাকে প্রেমপত্র লিখেছে, কিন্তু মিছিমিছি রূপ্পনবাবুর নাম জুড়ে দিয়েছে।
দ্বিতীয় খবরঃ বেলা রূপ্পনবাবুকে চিঠি লিখেছে। রূপ্পন তার জবাব দিইয়েছেন, কিন্তু সেটা গয়াদীনের হাতে পড়ায় ইজ্জতে গ্যামাক্সিন হয়ে গেছে।
তৃতীয় খবরঃ বেলা একটি খারাপ মেয়ে। --এই গল্পটাই বেশি প্রসিদ্ধ হল।
(চলবে)